
রাজধানীসহ সারা দেশে যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ ২১ দিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার জনকে। কিন্তু কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী বা দাগি অপরাধী ধরা পড়েনি। আবার উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে ছুরি, রামদা, লাঠি, রডই বেশি; আগ্নেয়াস্ত্র মাত্র ৩৯টি। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে পুলিশের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের একটি রয়েছে। উদ্ধারের বাইরে রয়েছে পুলিশের আরও প্রায় ১ হাজার ৪০০ আগ্নেয়াস্ত্র এবং আড়াই লাখ গোলাবারুদ।
এই বিশেষ অভিযানের মধ্যেই ছিনতাই, সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি, গুলি, হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধ ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলার উন্নতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পুলিশ বলছে, অভিযান চলছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। অনেক সন্ত্রাসী দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে যৌথ বাহিনী সারা দেশে একযোগে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করে। গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় সেদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই বিশেষ অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়।
অপারেশন ডেভিল হান্টের মূল উদ্দেশ্য অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার। ৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ১ মার্চ বিকেল পর্যন্ত অপারেশন ডেভিল হান্টে সারা দেশে ১২ হাজার ৫০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে এই বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী বা দাগি অপরাধী নেই। একই সময়ে পুলিশ আরও ২০ হাজার ৪৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের দাবি, এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা ও পরোয়ানা ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত কয়েক মাসে জামিনে কারাগার থেকে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অনেক সন্ত্রাসী মুক্তি পেয়েছে। তারা আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে। সন্ত্রাসীদের ‘অপরাধ সাম্রাজ্যে’ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জেরে হামলা, গুলি, খুনের ঘটনাও ঘটেছে।
নিউ এলিফ্যান্ট রোডে একটি মার্কেট দখলকে কেন্দ্র করে দুই ব্যবসায়ীকে কোপানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে সাজেদুল ইসলাম ইমনকে। এ ঘটনায় নাম এসেছে পিচ্চি হেলালেরও। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। তবে দুজনের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। গোয়েন্দাদের তথ্য বলছে, কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কারাগার থেকে মুক্তির পর ইমন বিদেশে চলে গেছেন—এমন কথা বলেছেন তাঁর মা।
উদ্ধার অস্ত্রের মধ্যে লাঠি, ছুরি, রামদা, রড বেশি
পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যানে বিশেষ অভিযানে অবৈধ অস্ত্র, গুলি উদ্ধারও উল্লেখযোগ্য নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ২১ দিনে ১৪টি পিস্তল, চারটি পাইপগান, সাতটি এলজি, নয়টি ওয়ান শুটার গান, আগস্টে পুলিশের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে একটি চায়নিজ রাইফেল, পাঁচটি একনলা বন্দুক, ১৩টি ম্যাগাজিন, ১০৫টি গুলি, ৫১টি শটগানের কার্তুজ, ৩০টি ককটেল এবং ছুরি, রামদা, তলোয়ার, কুড়াল, হাতুড়ি, চাপাতি, করাত, ক্ষুর, হ্যামার, রড ও লাঠি মিলিয়ে ১৬১টি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গত বছরের ৫-৬ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানা, পুলিশের স্থাপনা ও কারাগারে হামলায় পিস্তল, রিভলবার, শটগানসহ ১১ ধরনের ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র। উদ্ধার না হওয়া ১ হাজার ৩৯২টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে মাত্র একটি উদ্ধার হয়েছে ‘ডেভিল হান্টে’। পুলিশের লুট হওয়া আড়াই লাখ গোলাবারুদও উদ্ধার হয়নি।
অভিযানের মধ্যেই ডাকাতি, ছিনতাই, গুলি, দম্পতিকে কোপ
অপারেশন ডেভিল হান্টের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি হয়েছে। টাঙ্গাইলে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতির প্রতিবাদে বিক্ষোভও হয়েছে। রাজধানীর বনশ্রীতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে নিজ বাসার নিচে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে পল্লবীতে দুই ভাই-বোনকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। মো. জসিম উদ্দিন ও শাহিনুর বেগমের পায়ে গুলি করা হয়। জসিমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, গুলি করার ঘটনায় সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; তবে অস্ত্রটি উদ্ধার হয়নি। অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে।
১৬ ফেব্রুয়ারি মহাখালীর কড়াইলে হোসেন আলী নামের এক যুবককে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে উত্তরায় রিকশাকে মোটরসাইকেলের ধাক্কা দেওয়া নিয়ে প্রতিবাদ করার জেরে এক দম্পতিকে রামদা দিয়ে কোপায় সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ওই মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা, পরোয়ানা রয়েছে, তাদের নিয়মিত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অভিযান চলমান, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। প্রতিদিনই কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। অভিযান চলাকালে আরও উদ্ধার হবে।