
এক ইউপি চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে পৃথক মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি হলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লাক মিয়া। তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম। গতকাল ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দুটি করা হয়।
দুপুর আড়াইটায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।
তিনি বলেন, ইউপি লাক মিয়ার বিরুদ্ধে ভিজিডি, ভিজিএফ, এলজিএসপি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জোরপূর্বক ভূমি দখল ও মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। লাক মিয়ার নামে থাকা ২৬৫ দশমিক ৬১ বিঘা জমি আদালতের মাধ্যমে ক্রোক করা হয়েছে, যার দালিলিক মূল্য ৭৫ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ টাকা। তার দুটি গাড়িও জব্দ করা হয়েছে। যেগুলোর মূল্য ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাবে থাকা ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৩২২ টাকা অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হয়েছে।
দুদক জানায়, ১৯৯০-৯১ করবর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী দুদকের অনুসন্ধানে চেয়ারম্যান লাক মিয়ার এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। আর ২০০৭-০৮ করবর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী তার স্ত্রী মাহমুদা বেগমের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও মানি লন্ডারিং আইনে পৃথক মামলা করা হয়েছে।
দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানান, লাক মিয়ার একজন কর্মচারী হচ্ছেন মহসিন মোল্লা। তার মাসিক বেতন ছিল ১২ হাজার টাকা। তার রয়েছে ১৪টি ব্যাংক হিসাব। এসব হিসাবের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন ১০ হাজার ৩২২ কোটি ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬২ টাকা। ১২ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী হলেও তিনি এনআরবি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড এবং মেসার্স এনআরবি ট্রেডার্সের মালিক। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসার পর মহসিন মোল্লা ও তার স্ত্রীর নামে নতুন অনুসন্ধান ফাইল খুলে বিস্তারিত অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, লাক মিয়ার বিরুদ্ধে চাল, গম ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওই বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের হদিস পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সাড়ে ৪০০ বিঘার ওপর জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানীর বাড্ডা, খিলক্ষেতে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্রায় ১৫০ কাঠা জমি রয়েছে। এ ছাড়া লাক মিয়ার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের ১৪টি মৌজায় (মারুয়াদী, মুড়ালদী, লস্করদী, মুলপান্দী, যাত্রাবাড়ী, দিঘলদী, উজান গোবিন্দী, ফাউসা, বড় মনোহরদী, রিষেরচর, বিনাইরচর, ইদবারদী, নরিংদী ও ছোট মনোহরদী) ৯১ একর ৬৯ শতাংশ ৩৫ অযুতাংশ জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আড়াইহাজার পৌরসভার মধ্যে থাকা তিনটি মৌজায় (কামরাঙ্গীরচর, আড়াইহাজার ও ঝাউগাড়া) ১৭ একর ৯৬ শতাংশ ২১ অযুতাংশ জমি রয়েছে। প্রিমিয়াম ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, পূবালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থ হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ করা হয়েছে। জানা যায়, লাক মিয়া ও তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম, সন্তান মিনজু আক্তার ও হাফসা আক্তারের বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করে দুদক। আবেদনের শুনানি নিয়ে গত বছরের ১৪ অক্টোবর ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন তা মঞ্জুর করেন এবং দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর লাক মিয়ার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ২৭ আগস্ট তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। প্রথম দফায় তিনি চিঠি রিসিভ করেও দুদকের ডাকে সাড়া দেননি। এরপর আরও দুই দফায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বরও তিনি হাজির হননি। বরং প্রথম জিজ্ঞাসাবাদের নোটিস পাওয়ার পরপরই তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত থাকা কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করেন। এর প্রমাণ দুদকের অনুসন্ধান টিমের হাতে রয়েছে।