
মব সৃষ্টি করে লুটপাট কিংবা গণপিটুনি। এ যেন এক নতুন আতঙ্ক। চরম উদ্বিগ্নতায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই ঘটছে এমন ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণ অভ্যুত্থানের সাত মাস পেড়িয়ে গেলেও একটি মহল নানা কায়দায় মব সৃষ্টি করে এখনো সুবিধা নিচ্ছে। তাদের থাবা থেকে বাদ যাচ্ছে না খোদ পুলিশও। অন্যদিকে, একাধিক সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে এসব ঘটনার নেপথ্য। বেশির ভাগ ঘটনাই টার্গেট করে ঘটানো হচ্ছে। চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গণপিটুনি কিংবা গণতল্লাশির নামে। এমন ঘটনার শেকল টানতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের ইঙ্গিত দিয়েছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্কতা জারি করেছে। আহ্বান জানিয়েছে, আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মবের প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘মব তৈরি’ করে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা আউটার রিং রোডে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ইউসুফ আলীর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ১২ জনকে আটক করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে গণপিটুনির অন্তত ১০০৯টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন। তবে চলতি ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে ৩০টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন। আহত হয়েছেন ২০ জন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সাত মাসে গণপিটুনির ১১৪টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১৯ জন। আহত হয়েছেন ৭৪ জন। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশানের একটি বাড়িতে মব সৃষ্টি করে তল্লাশির নামে লুটপাট চালানো হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর ওই বাসায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ, অস্ত্র ও আওয়ামী লীগের দোসরদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এমন তথ্য ছড়িয়ে উসকে দেওয়া হয় স্থানীয় জনতাকে। একপর্যায়ে মধ্য রাতে দরজা ভেঙে ‘তল্লাশির’ নামে ২০-২৫ জন লোক ঢুকে পড়ে। বাসাটি তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা করে। ৯৯৯-এর মাধ্যমে খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে যান গুলশান বিভাগের ডিসি, গুলশান থানার ওসিসহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার করে শাকিল খন্দকার (২৪), জুয়েল খন্দকার ( ৪৮) এবং শাকিল আহমেদকে (২৮)। এদের মধ্যে জুয়েল খন্দকার ও শাকিল খন্দকার সম্পর্কে বাবা-ছেলে।
প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশ বলছে, শাকিল আহমেদ এক সময় বাসায় কেয়ারটেকারের কাজ করতেন। মূলত শাকিলই জনতাকে ওই বাসায় প্রবেশের বিষয়ে উসকানি দিয়েছিলেন। এর দুই দিন আগেও রাত সাড়ে ১০টার দিকে একই অজুহাতে একদল জনতা বাসাটিতে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। পরবর্তীতে পুলিশ এসে তাদের বুঝিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের ধীরাশ্রমে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরদিন থেকে সারা দেশে যৌথ বাহিনীর অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হয়।
গুলশানের বাড়িতে লুটপাটের ঘটনায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে তিনি বলেন, এক শ্রেণির প্রতারকচক্র দুদকের কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির বাসভবনে দুর্নীতিবিরোধী তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করছে। একই সঙ্গে অর্থ দাবি করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রতারকচক্র সাধারণ মানুষকে হয়রানি করাসহ দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করছে। গত সোমবার রাতে চট্টগ্রামে সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকার সেই ঘটনায় মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত ঢুকেছে’ বলে মব তৈরি করে দুই যুবককে গণপিটুনি দিলে তারা মারা যান। হামলার সময় ওই যুবকদের গুলিতে স্থানীয় চার বাসিন্দা আহত হয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, আটটি গুলির খোসা এবং একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করেছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। পুলিশ জানায়, ওইদিন রাতে মাদারীপুরের রাজারচর এলাকায় বাল্কহেডে ডাকাতির চেষ্টা করে ডাকাতরা। স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া করে। ডাকাতরা শরীয়তপুরের তেঁতুলিয়া এলাকায় গেলে স্থানীয়রা নদীতে বাল্কহেড দিয়ে তাদের গতিপথ রোধ করে। এ সময় ডাকাতরা হাতবোমা ও এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে গুলিতে আহত হন চারজন। পরে ডাকাতরা স্পিডবোট ফেলে পালানোর চেষ্টা করলে সাতজনকে আটক করে গণপিটুনি দেয়া হয়। ওই সাতজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চারজন মারা যায়। পরে আরেকজনের লাশ নদীতে ভেসে ওঠে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুলিশ এখনো ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি। সরকারের উচিত হবে তাদের আরও মোটিভেট করা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত হবে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে তাদের উৎসাহ দেওয়া। পুলিশকে স্বাভাবিক না করতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ মো. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এবং অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। মব সৃষ্টি করে যেসব ঘটনা ঘটছে তা আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। সুযোগসন্ধানী এবং অপরাধীরা নানা গুজব রটিয়ে মব সৃষ্টি করছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা মব জাস্টিসে জড়াচ্ছেন, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন। ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে পুলিশের সহায়তার অনুরোধ করেন তিনি।