
রঞ্জিত চন্দ্র সরকার। রঞ্জিত সরকার নামেই পরিচিত। উইকিপিডিয়ায় তার পরিচিতি আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। সিলেট জেলা বারের ডকুমেন্টে তার স্থায়ী এবং বর্তমান ঠিকানা গোপালটিলা, টিলাগড়, সিলেট। ‘রঞ্জিত’ নামটি সিলেটের আওয়ামী গ্রুপিং রাজনীতিতে নানা কারণে আলোচিত। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নববধূকে গণধর্ষণের ন্যক্কারজনক ঘটনা থেকে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের চাঞ্চল্যকর ‘পাঁঠা’ লুটের কাণ্ডে- রঞ্জিত সরকার নামটি ঘুরে ফিরে এসেছে। সর্বশেষ সিলেট জজ কোর্টের এজলাসে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়ও ছিল তার নাম। মানুষের কাছে নানা অভিধায় আখ্যায়িত তিনি। কারও কাছে ‘ইসকন রঞ্জিত’, কারও কাছে তিনি আবাদি। জনশ্রুতি আছে, স্থানীয় চেয়ারম্যান পরিবারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দুঃসাহসই তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে।
সিলেটের পূর্বাঞ্চলীয় তামাবিল সড়কে এক সময় একক নিয়ন্ত্রণ ছিল রঞ্জিতের গুরু স্থানীয় টুলটিকর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের। তাদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ আশ্রয় নিতো সিলেটে ‘বাংলা ভাই’ কুখ্যাতি পাওয়া সুনামগঞ্জের তাহিরপুর নিবাসী রঞ্জিত সরকারের কাছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে রঞ্জিত এবং তার বাহিনী তামাবিল রোডে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, গোটা এলাকা জিম্মি হয়ে পড়ে। রঞ্জিত বাহিনী হয়ে উঠে সিলেট শহরের পূর্বাঞ্চলের মূর্তিমান আতঙ্ক।
টিলাগড়ে উত্থান হলেও জাফলং থেকে তাহিরপুরের শিমুলবাগান পর্যন্ত অপরাধের নেটওয়ার্ক ছিল ৭ মাসের এমপি রঞ্জিত সরকার এবং তার বাহিনীর।
৫ই আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের একেবারে শেষ সময় অবধি মাঠে ছিল রঞ্জিত গ্রুপের অস্ত্রধারীরা। হাসিনার পতনের পরপরই অনেকের মতো রঞ্জিত এবং তার প্রধান সহযোগী কমিশনার জাহাঙ্গীরও পালিয়েছে। ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার তাৎক্ষণিক ক্ষোভের থাবা পড়ে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে। কিন্তু সিলেটের রাজনীতির বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য স্মরণে তা নিয়ন্ত্রণে আনেন স্থানীয় মুরব্বিরা। একাধিক মুরব্বির ভাষ্য মতে, গত ক’বছরে রঞ্জিত-জাহাঙ্গীর বাহিনীর হাতে যত নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটেছে, চলার পথে কতো মানুষ বর্বরতার শিকার হয়েছে সেই তুলনায় এই প্রতিক্রিয়া সামান্যই। একজন বাদাম বিক্রেতাও তাদের চাঁদা না দিয়ে হাঁটতে পারেনি তামাবিল সড়কে। ওই সড়কের দুই পাশের জমি- জিরাত বিক্রি, বিল-ঝিল বন্ধক কিংবা ছড়ার বালু উত্তোলন তো বটেই, মানুষ বাজারঘাট করতেও তাদের সালামি দিতে হতো। না হয় ধরে নিয়ে রঞ্জিত-জাহাঙ্গীর বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন টর্চারশেলে চলতো অমানবিক-অকথ্য নির্যাতন। সিলেট তামাবিল সড়কেই ছিল তাদের ৩টি চর্চার সেল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হওয়ার পর অনেকে বলছেন, সিলেটের নাম্বার ওয়ান ডেভিল ছিল এই রঞ্জিত।
রঞ্জিতের উত্থান যেভাবে? হাওর জনপদ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ছেড়ে ভাগ্য বদলে রঞ্জিতের বাবা মনমোহন সরকার সিলেটে আসেন। তার অন্য আত্মীয়রা ততদিনে শিবগঞ্জের খরাদিপাড়ায় থিতু হয়েছেন। টিনশেডের একটি বাড়িতে ঠাঁই হয় তাদের। রঞ্জিতের বড় ভাই তাপস তখনো স্কুলের ছাত্র। রঞ্জিত তো আরও ছোট। সংসার চালাতে মনমোহন সরকার প্রথমে একটি পানের দোকান দেন, পরবর্তীতে তা মুদি-মনিহারিতে রূপ নেয়। লামাপাড়ার প্রবেশমুখে ছিল দোকানটির অবস্থান। দুই ভাই তাপস-রঞ্জিতকে ভর্তি করেন হাতিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুল শেষে তাপস-রঞ্জিত দু’জনই বাবার ব্যবসায় সময় দিতেন। সামনে পানের দোকান, পেছনে মুদি মাল- এভাবেই চলছিল। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে রঞ্জিত ভর্তি হন সরকারি কলেজে। যা তখন এমসি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ। কলেজে খুব একটা নিয়মিত ছিলেন না তিনি। পাড়ার অন্য ছেলেদের সঙ্গে তার বেশ সখ্যতা হয়। কিশোরদের নিয়ে তিনি একটি গ্রুপ গড়ে তোলেন। সাহসী কিশোর হন সেই গ্রুপের লিডার। তাদের দলবদ্ধ যাতায়াত শুরু হয় সিলেট সদর উপজেলার ৫ নং টুলটিকর ইউনিয়নের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মানিকের বাসায়। পরিবহন সেক্টর বিশেষ করে তামাবিল স্থলবন্দর অভিমুখী ট্রাক পরিবহন ব্যবসায়ী মানিক স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। টিলাগড়ে তাদের বসতি। মানিকের সহোদর আজাদুর রহমান আজাদ। ৪ বারের কাউন্সিলর। গ্রুপিং রাজনীতির কারণে পরিচিতির দিক থেকে এখন মানিককে ছাড়িয়ে গেছেন আজাদ। ’৯৬ থেকে ২০২১ আওয়ামী শাসনামল তো বটেই, পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এমনকি ওয়ান ইলেভেনের সরকারের আমলেও মানিক-আজাদ ব্রাদার্সের কথাই ছিল টিলাগড় অঞ্চলের শেষ কথা। সম-সাময়িক আজাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে চেয়ারম্যান মানিক পরিবারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেন কিশোর গ্যাং লিডার রঞ্জিত সরকার। টুলটিকর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গুরু আজিজুর রহমান মানিকের জন্য কেন্দ্র দখল করতে গিয়ে পাইপগানসহ ধরা পড়ে কিশোর ক্যাডার রঞ্জিত। তখনো ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তার কোনো অবস্থান নেই। দীর্ঘদিন জেল খাটার পর মুক্তি মিলে। ছাত্র জীবনেই রঞ্জিত রপ্ত করেছিলেন সন্ত্রাসের নানা কলা কৌশল। বোমা বানাতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার একটি চোখ।
ততক্ষণে পড়াশোনা লাটে। রঞ্জিতের ওপর নজর পড়ে জেলার নেতাদের। চেয়ারম্যান পরিবার তো বটেই। ভাইয়ের জন্য জেলে যাওয়ায় চেয়ারম্যান সহোদর আজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। বলতে গেলে তখন তারা মানিকজোড়। এভাবেই চলছিল ২০০৫ সাল পর্যন্ত। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। তাদের মোকাবিলায় আজাদ-রঞ্জিত এক থালায় খেয়েছেন। এক সঙ্গে হেঁটেছেন। ছাত্ররাজনীতি থেকে মূল দল। অনেক রজনী এক সঙ্গে পার করেছেন তারা। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত শুরু হলেও গ্রুপ ভাঙ্গেনি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট। মানিক-আজাদ পরিবার নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সক্রিয়। তার বিশ্বস্ত এবং ওই পরিবার তথা টিলাগড় গ্রুপের স্বার্থ রক্ষাকারী ক্যাডার রঞ্জিত সরকার ভেতরে ভেতরে অনেক দূর এগিয়ে গেছে নিজস্ব বলয় তৈরিতে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে নানা ইস্যুতে বাড়তে থাকে তাদের বিরোধ, যা অভ্যন্তরীণ সংঘাতে রূপ নেয়। মানিক-আজাদ পরিবারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সুযোগটা কাজে লাগান রঞ্জিত। ওই অঞ্চলের মানুষজন যারা মানিক-আজাদ পরিবারের রোষের শিকার হতেন তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেন তিনি। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীর এক্সটেনশন শুরু করেন। শাহপরান অবধি তখনই বিস্তৃতি ঘটেছে সিলেট মহানগরীর। পাশের এলাকার কাউন্সিলর জাহাঙ্গীরকে নিয়ে শক্ত গ্রুপ গড়ে তোলেন অল্পদিনেই। ধীরে ধীরে রঞ্জিত-জাহাঙ্গীরের অপরাধ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। তারা কেবল এমসি আর সরকারি কলেজই নয়, একে একে সব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। মহানগরীর এক্সটেনশনের সুবাধে পূর্বাঞ্চলে নতুন নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে। রঞ্জিত বাহিনীর আয়ের প্রথম উৎস ছিল তামাবিল থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি। কিন্তু তাতে তাদের হচ্ছিলো না। পূর্বাঞ্চলে গড়ে ওঠা নতুন নতুন আবাসিক এলাকায় যে বা যারা বাইরে থেকে এসে বাড়িঘর করতেন তাতে বালু-পাথর সাপ্লাইয়ের নামে চাঁদাবাজি শুরু করে রঞ্জিত বাহিনী। ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বলয় বাড়তে থাকে। মেজরটিলা, শাহপরান তথা পূর্বাঞ্চলের চারটি উপজেলা কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট এবং জকিগঞ্জের প্রবাসী ও ব্যবসায়ী পরিবারের বাস। দুর্দান্ত প্রতাপশালী মানিক-আজাদ পরিবারের ক্ষমতা তখন ম্রিয়মাণ। তাদের তখন পড়ন্ত বিকেল। সেই সুবাদে রঞ্জিত-জাহাঙ্গীর কেবলই উড়ছেন।
এলএলবি পরীক্ষা, সনদ এবং... রঞ্জিত সরকারের এলএলবি পরীক্ষা এবং সনদ অর্জন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ মহলে। তার এলএলবি পরীক্ষার সেন্টার ছিল এমসি কলেজে। পরীক্ষার হলে বই নিয়ে প্রবেশের অপরাধে তার খাতা আটকে রেখেছিলেন এক সময়ের প্রভাবশালী শিক্ষক আব্দুল মান্নান। কালা মান্নান খ্যাত সেই শিক্ষককে দলবল নিয়ে হুমকি দিয়ে খাতা ছিনিয়ে আনেন ক্যাডার রঞ্জিত। পরবর্তীতে তিনি অর্থকড়ি খরচ করে সনদ নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এলএলবি সনদ পাওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রেকর্ড বলছে- ২০০৩ সালের মাঝামাঝিতে সিলেট জেলা বারের সদস্য হন রঞ্জিত।
খরাদিপাড়া থেকে গোপালটিলা: টিলাগড় লাগোয়া গোপালটিলা নিয়ে তখন ভাগ-বাটোয়ারা চলছে। নামমাত্র মূল্যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টিলার একটি প্লট কিনে নেন রঞ্জিত সরকার। সিলেট জেলা বারের রেকর্ডে থাকা তথ্যমতে ৯২ গোপালটিলা এখন রঞ্জিতের স্থায়ী এবং বর্তমান ঠিকানা। এই গোপাল টিলায় তিনি গড়েছেন আলিশান ৫ তলা বাড়ি।
শেখ হাসিনার শাসন যত পোক্ত হতে থাকে আওয়ামী লীগ নেতা রঞ্জিত সরকারের অপরাধের সাম্রাজ্য ততই বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। স্বর্ণ ও গরু চোরাচালানে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে তার সিন্ডিকেট। জাল বিছাতে থাকেন জাফলং, বিছনাকান্দি, সারি নদীতে। বালু-পাথর লুট করতে থাকেন দেদারছে। নিজস্ব বাহিনীর এক্সটেনশনও হতে থাকে। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে বিরোধীরা কোণঠাসা হওয়ায় সিলেট-তামাবিল সড়কে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রঞ্জিত গ্রুপ। ততক্ষণে করোনা চলে আসে। বর্ডার বন্ধ হয়ে যায়, চোরাচালান তো বন্ধই, নিয়মিত বাণিজ্যও মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু নিউ নরমাল করোনা সিলেট সীমান্তে এক ভয়াবহ রূপ নিয়ে আসে। তখন রোহিঙ্গা ঢলের মতে নামতে থাকে চিনি। ওই রুট দিয়ে যাতায়াতকারী চিনি চোরাচালানে যুক্ত ট্রাকগুলো রঞ্জিত সিন্ডিকেটকে চাঁদা না দিয়ে শাহপরান বাইপাস বা টিলাগড় পার হতে পারতো না। অবশ্য পরবর্তীতে তামাবিল-সিলেট তথা ঢাকা পর্যন্ত রুটে প্রভাবশালী চিনি চোরাচালান বৃহত্তর সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। হরিপুর হচ্ছে সেই চিনি সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার। যেখানে বিরোধী বা ভিন্ন মতের প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের ক্যাডারদের ভাগও নিশ্চিত করা হয়। ৭০ দশক থেকে হরিপুর বোঙ্গা রাজ্য। তখনকার পণ্য ছিল ভারতীয় পাতার বিড়ি, যা নাসির বিড়ি নামে পরিচিত। সঙ্গে ইন্ডিয়ান শাড়ি ও জুতো, গরু-মহিষ আসতো যৎসামান্য। এটা ছিল ওপেন সিক্রেট। মদ-ফেনসিডিলের চালান আসলেও তা ছিল অত্যন্ত গোপনে। হরিপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বহুবার অভিযান করেছে। কিন্তু সফলতা এসেছে খুব কমই। এক পর্যায়ে রঞ্জিত গ্রুপের মাধ্যমে রুটের প্রতিটি পয়েন্টে চোরাচালান সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে প্রশাসনকেও ম্যানেজের চেষ্টা করা হয়। যারা তাদের ভাগ নিতেন না তাদের নানাভাবে ডিস্টার্ব করা হয়। করোনা পরবর্তী সময়ে সিলেট এয়ারপোর্টকে নিজের আধিপত্য বলয়ের ভেতরে নিয়ে আসেন রঞ্জিত। বিশেষত স্বর্ণ চোরাচালান। দেবাশিসকে দিয়ে এয়ারপোর্টে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন রঞ্জিত। বছরখানেক আগে ঢাকায় ৮০ কেজি স্বর্ণ নিয়ে ধরা পড়া আলী নামক স্বর্ণ চোরাকারবারি ওসমানী রুটে দেবাশিসের নাম বলেছিল।
শাহপরান বাইপাসে রঞ্জিতের নামে- বেনামে শত বিঘা জমি দখল: রঞ্জিত বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল সিলেটের গোটা পূর্বাঞ্চল। শাহপরান বাইপাস এলাকায় একটি জমির দখল নিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। নাছোড়বান্দা রঞ্জিত পিছপা হননি। তিনি এই জমির দখল নেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে। বাইপাস এলাকায় নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন জনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রায় অর্ধশত বিঘা জমির মালিক রঞ্জিত।
স্মরণ করা যায়, টিলাগড়ে গত ১৫ বছরে ১০-১২টি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবই হয়েছে আধিপত্য নিয়ে আজাদ-রঞ্জিতের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। ২০১০ সালে উদয় সিংহ হত্যা দিয়ে টিলাগড়ে রক্তের হলি খেলা শুরু। উদয় সিংহ রঞ্জিত গ্রুপের ছিল। পরবর্তীতে রঞ্জিত গ্রুপের আরও ৩ জন নিহত হন। তখনো টিলাগড়ের নিয়ন্ত্রণ আজাদ গ্রুপের হাতে। রঞ্জিত পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যে তিনি ওই তিন খুনের বদলা নেন। পাল্টাপাল্টি খুনে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয় টিলাগড়। প্রকাশ্য অস্ত্রবাজি শুরু হয় টিলাগড়ে। আশপাশের বহু এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্কের জনপদের পরিচিতি পায় এই এলাকা। আর এরপর থেকেই টিলাগড়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রঞ্জিতের হাতে। নিজে হয়ে উঠেন টিলাগড় রাজ্যের গডফাদার। এক সময়ের মিত্র আজাদকে টেক্কা দিতে নিজের ভাগিনা মিঠু তালুকদারকে দাঁড় করান সিটি নির্বাচনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে। পাশের ৩৫ নং ওয়ার্ডে রঞ্জিতের অপরাধের অন্যতম সহযোগী জাহাঙ্গীর, ৩৩ নং ওয়ার্ডে রুহেল আহমদকে দাঁড় করান। জয়ও পান তারা দুজন। অস্ত্রের মুখে ভোটারদের জিম্মি করে জয় ছিনিয়ে নেয় তারা। ২০১৩ সালে ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে আধিপত্য বিস্তার করে অগ্নিসংযোগ করেছিল রঞ্জিতের লোকজন। ওই ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
২০২৪ সালের নির্বাচনে রঞ্জিতের পৈতৃক নিবাস সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে নৌকার টিকিট বাগিয়ে নেন রঞ্জিত। ডামি প্রার্থীর বিরুদ্ধে ক্যাডার রঞ্জিত সহজে জয় ছিনিয়ে নেন নিজের পেশিশক্তি খাটিয়ে। রঞ্জিতের অপরাধ রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে সুনামগঞ্জ অবধি। সুনামগঞ্জের সাংবাদিকদের ভাষ্য মতে রঞ্জিত ৬ মাসে যা করেছেন তার পূর্বসূরি ওই আসনের ১৫ বছরের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন তা করতে পারেননি। একজন সাংবাদিকের ভাষ্য, ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে রঞ্জিতদের পতন হয়েছে, অন্যথায় সুনামগঞ্জ-১ আসনটাই বিক্রি করে দিতেন তিনি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এমপি হওয়ার পর রঞ্জিত নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের বাইরে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এই বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন রঞ্জিত।
সাত মাসের এমপি রঞ্জিত রাজধানীর গুলশান ও উত্তরাতেও দু’টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক। এ ছাড়া তিনি তার পৈতৃক নিবাস সুনামগঞ্জের তাহিরপুরেও অনেক সম্পদ গড়েছেন। ৫ই আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে রঞ্জিতের গোপালটিলার আলিশান বাড়ি।