Image description
 

স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সবুজ সংকেত ছাড়া আগামীতে তথ্যবিনিময়ের জন্য কোনো সেবাপ্রত্যাশী সংস্থার সঙ্গে চুক্তিতে যাবে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় ভোটার পরিচয়পত্রে (এনআইডি) থাকা নাগরিকের তথ্য যাচাইয়ে আগের প্রতিষ্ঠানগুলো শর্ত ভঙ্গ করায় কঠিন এ সিদ্ধান্ত ইসির। কমিশন সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে এনআইডির তথ্য যাচাইয়ের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন কঠিন হবে।

 

এ ছাড়া আগামীতে যারা এনআইডির সেবা নেবে, তাদের এ কাজের জন্য নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি নিয়োগ করতে হবে। তার সঙ্গেই যোগাযোগ করবে ইসি। বদলি কিংবা কোনো প্রয়োজনে তাকে সরানো হলে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের আগে এনআইডি কর্তৃপক্ষকে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে।

 

কোনো সেবাপ্রত্যাশী সংস্থা তৃতীয়পক্ষের কাছে তথ্য বিক্রি করলে বা চুক্তির শর্ত ভাঙলে আজীবন নিষিদ্ধ হবে। শর্ত লঙ্ঘন করায় ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে কমিশন। এ ছাড়াও কয়েকটির কাছে তথ্যের অপব্যবহারের অপরাধে ব্যাখ্যা ও দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে পত্র দিয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।

 

ইসির কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা নাগরিকের তথ্য যাচাইয়ের নামে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সেবাপ্রত্যাশী সংস্থাগুলো চুক্তি করে তথ্য নিয়ে শুরু করেছিল নয়ছয়। দ্বিপক্ষীয় চুক্তিকে (ইসি ও সেবা সংস্থা) বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তৃতীয়পক্ষের কাছে তথ্য বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছিল কোটি কোটি টাকা। এনআইডিতে থাকা নাগরিকের তথ্য সস্তায় পাওয়া যেত।

 

ধারণা পাওয়া গেছে, এনআইডি তথ্যভান্ডার থেকে অন্তত পাঁচ কোটি নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য বিক্রি হয়েছে। তা নিয়েছে সরকারি-বেসরকারি ও দেশি-বিদেশি শতাধিক প্রতিষ্ঠান। তালিকায় ছিল এনজিও-ও। পরিচয় নামে ওই প্রতিষ্ঠান প্রতি একজন ব্যক্তির তথ্যের জন্য ৫, ১০ ও ১৫ টাকা হারে আদায় করে। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই ‘পরিচয়’ উদ্বোধন করেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

 

জানা যায়, বিগত সরকারের আমলে এনআইডি উইং হয়ে পড়েছিল অভিভাবকহীন। সেবাপ্রত্যাশী সংস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না কর্তৃপক্ষের।

এদিকে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ইসিতেও সংস্কারের হাওয়া লাগে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মদতপুষ্ট কমিশন পদত্যাগ করে। নতুন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে ইসি সচিবালয়ের পাশাপাশি এনআইডিতে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে।

 

এরই ধারাবাহিকতায় এনআইডির তথ্য নিয়ে নয়ছয় করার ইস্যুটি সামনে আসে। ইসির হাতে থাকা ১২ কোটির বেশি নাগরিকের তথ্য আমানত হিসেবে সুরক্ষিত রাখতে নতুন নতুন কৌশল ও উপায় সন্নিবেশ করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় আগামীতে সেবাপ্রত্যাশী সংস্থাগুলো এনআইডির তথ্য যাচাইয়ের জন্য ইসির সঙ্গে চুক্তি করতে চাইলে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে যাচাই করা হবে। সেখান থেকে সবুজ সংকেত পেলে এনআইডি কর্তৃপক্ষ ওই সংস্থার সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে চুক্তি করবে। শর্ত লঙ্ঘন করলে বাতিল হবে চুক্তি।

 

এনআইডির সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচন কমিশন থেকে এনআইডির তথ্য-উপাত্ত যাচাই সেবা গ্রহণকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৮৩টি। এর মধ্যে ইসির সঙ্গে বিসিসির দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয় ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর। শর্তানুযায়ী দ্বিতীয় পক্ষ (বিসিসি) কমিশনের তথ্য-উপাত্ত কোনো অবস্থায়ই অন্য কোনো ব্যক্তি, স্বত্বা, পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর, বিনিময়, বিক্রি কিংবা অন্য কোনো পন্থায় প্রদান করতে পারবে না। কিন্তু বিসিসি তা না মানায় গত বছরের ২২ ডিসেম্বর চুক্তি বাতিল করে ইসি। পুনরায় চুক্তি করতে চাইলেও রাজি হয়নি ইসি।

 

এ ছাড়া অর্থ বিভাগের বাংলাদেশ অটোমেটেড চালান সিস্টেম (ব্যাসই)-এর ওয়েব পোর্টালে ব্যবহৃত এপিআই অর্থেনটিকেশন ক্রেডেনশিয়াল ডেভেলপমেন্ট ও মনিটরিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যার ডেভেলপার এবং কারিগরি শাখার জনবলের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তির ক্রেডেনশিয়াল কম্প্রোমাইজ হয়েছে বলে এনআইডির তদন্ত টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে অনিয়মের তথ্য উদঘাটন করে।

 

এই অপরাধের কারণে ইসি গত ৩ ফেব্রুয়ারি এনআইডি থেকে অর্থ বিভাগের এনআইডি তথ্য যাচাইয়ের লিংক স্থগিত করার বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চায়। একই সঙ্গে অর্থ বিভাগের যারা এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও আগামীতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে অর্থ বিভাগকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। শুধু অর্থ বিভাগ একা নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মহিলা অধিদপ্তর একই ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে ইসির তদন্ত টিম সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কারিগরি যাচাইয়ে নিশ্চিত হয়। অর্থ বিভাগের মতো এসব প্রতিষ্ঠানকেও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে এনআইডি কর্তৃপক্ষ।

 

এনআইডির ডিজি এএসএম হুমায়ুন কবির আমার দেশকে বলেন, যেসব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনআইডিতে থাকা নাগরিকের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করতে চাইবে, তাদের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি করতে হয়। যারাই আগ্রহী হতো, বিদ্যমান শর্ত অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ হতআ। কিন্তু আগামীতে এভাবে কোনো চুক্তি হবে না।

 

যারা সেবাপ্রত্যাশী, গোয়েন্দা সংস্থা (এসবি-এনএসআই) দিয়ে তাদের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স নেয়ার পর চুক্তি হবে। যিনি এ দায়িত্ব পালন করবেন, তিনি তথ্যটি আমাদের জানাবেন। কমিশন তথ্যসেবার বিষয়ে তার সঙ্গেই যোগাযোগ করবে। কেউ বদলি বা চাকরি ছাড়লে নতুন কর্মকর্তাকে সেটিও জানাতে হবে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের টেকনিক্যাল হ্যান্ড যারাই এখানে কাজ করবেন, তাদের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে চুক্তির আওতায় যারাই থাকবেন, সবার বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য থাকবে। এতে জবাবদিহি তৈরি হবে, যা আগে ছিল না।