Image description
 

মাত্র ১০ দিনের মধ্যে দেশে চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো। এর মধ্যে গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় অনুভূত হওয়া কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলেন, বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এটিকে মাঝারি মাত্রার হিসেবে ধরা হয়। কম্পনের উৎপত্তিস্থল ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ৪৪৯ কিলোমিটার। 

গতকাল ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। এর আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টা ৬ মিনিটে দেশে ভূকম্পন অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল নেপালের কোদারি এলাকা। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। এটি মাঝারি মাপের ভূমিকম্প। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম রাজ্যের মরিগাঁও, মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩। তার আগের দিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে। মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে তিনবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। 

 
 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আশপাশে ও দেশের ভেতরে ছোট বা মাঝারি আকারের ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪১। গত বছর তা বেড়ে হয় ৫৪। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

 

এভাবে ছোট বা মাঝারি ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পরম্পরা বিশ্লেষণ এবং দিন দিন সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এমনটা তারা মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেড়ে গেলেও তা মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। এখনও ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ভূমিকম্প-পরবর্তী সম্ভাব্য উদ্ধার প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর জন্য নাগরিক শিক্ষা ও মহড়া– উভয়েরই অভাব আছে।

 

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলেন, আমাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ইউনিট বেড়েছে। আগে ছিল চারটি। ২০০৭ সাল থেকে ১৩টির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ হয়। 

বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির বিষয়টি বোঝাতে একখণ্ড কাঠের টুকরোর উদাহরণ তুলে ধরেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তিনি বলেন, কাঠের টুকরোর দু’পাশে যদি ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়, তবে এর ভেতরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। এভাবে এক সময় কাঠটি চিরে যেতে পারে। এক পর্যায়ে ফেটে যাবে। বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, সেটা এখন কাঠের চিরে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে। 

সাধারণত দুই ধরনের ভূমিকম্পের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি হলো রিখটার স্কেলে ৮ বা এর চেয়ে বেশি। আরেকটি হলো ৭ বা এর চেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হয়, তার মধ্যে সাধারণত ৮ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর ফিরে আসে। আর ৭ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ১২৫ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে ফিরে আসে।

বাংলাদেশ বা এই ভূখণ্ডে বড় ভূমিকম্পের মধ্যে আছে ১৭৬২ সালেরটি। মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এটি ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এতে চট্টগ্রাম, ফেনী এমনকি কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর পর ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার। ১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার এবং ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ১৮৬৯ সালে সিলেটের কাছার এলাকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ও ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরেও বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এ কারণে সেখানে বড় ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সেটিকে নাড়াচাড়া দিতে পারে। সম্প্রতি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি মানে এই নয়, আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তাই এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের সময় হয়ে গেছে। 

বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূগর্ভে যে পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে, তাতে সিলেটে ৭ থেকে ৮ মাত্রার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হতে পারে।