
ভালোবাসার জন্য পৃথিবীতে অনেকেই গড়েছেন অমর কীর্তি। ভারতবর্ষের সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজকে খুশি করতে তৈরি করেছেন তাজমহল। এ ছাড়া লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদের প্রেমকাহিনি বহুল চর্চিত। নিজের স্ত্রীকে খুশি করতে তেমনই এক নজির গড়েছেন ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও বর্তমানে ওয়াসার জরুরি পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল মজিদ। স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে নিজ দপ্তরের প্রায় সব কাজের টেন্ডারই বরাদ্দ দিয়েছেন স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে।
গত বছরই ২৫টি কার্যাদেশ দেওয়া হয় ‘প্রিমিয়াম কোয়ালিটি লিমিটেড’ নামের এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে, যার চেয়ারম্যান হলেন প্রকৌশলী মজিদের স্ত্রী তামান্না শারমীন। একই কাজের জন্য একাধিকবার বিল নেওয়ার পাশাপাশি কাজ না করেও বিল তুলে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। জানা যায়, গত বছর ঢাকা ওয়াসার মর্ডস সার্কেল-১ এর অধীনে জোন ১, ২, ৩, ৬ ও ৭ এর প্রায় ২৫টি কাজের বিল তুলে নেওয়া হয় প্রিমিয়ার কোয়ালিটি লিমিটেডের অনুকূলে। এ ছাড়া চলতি বছরের ২৬, ২৭ ও ৩০ জানুয়ারি তুলে নেওয়া হয় আরও ৩টি বিল। এসব বিল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একই শিরোনামের কাজে একাধিকবার বিল তোলা হয়েছে। যার মধ্যে ‘ওয়াটার পাম্প মেইনটেন্যান্স’ শিরোনামের কাজে বিল তোলা হয়েছে পাঁচবার
। গত বছরের ৬ জুন ‘ওয়াটার পাম্প মেইনটেন্যান্স’ কাজ দেখিয়ে বিল তোলা হয়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা, ৩০ জুন তোলা হয়েছে ৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, একই তারিখে একই কাজে আবার তোলা হয়েছে ৬ লাখ ৫২ হাজার ৫০ টাকা। ১৭ অক্টোবর একই কাজ দেখিয়ে বিল তোলা হয়েছে দুইবার। প্রথমবার ৪ লাখ ৯৩ হাজার, দ্বিতীয়বার ৪ লাখ ৮৮ হাজার। একই রকমভাবে ‘ওয়াটার লাইন মেইনটেন্যান্স’ নামে ৭ বার, ‘সুয়ারেজ লাইন মেইনটেন্যান্স’ নামে ৪ বার বিল তোলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিতে বিভিন্ন সূত্র থেকে ‘প্রিমিয়াম কোয়ালিটি লিমিটেড’ ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেট, বোর্ড রেজ্যুলেশন সংগ্রহ করা হয়। এসব কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইসেন্সে ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. আফজাল হোসেন। ব্যবসায়ের ধরন দেওয়া হয়েছে আইটি, আমদানি, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী বিক্রেতা, ঠিকাদারি, ফার্মেসি, সরবরাহকারী। তবে বোর্ড রেজ্যুলেশনে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তামান্না শারমিন নামের এক নারী। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ৫৮৩, অনামিকা কনকর্ড অ্যাপার্টমেন্টস।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই নম্বরের বাসায় থাকেন ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ ও ‘প্রিমিয়াম কোয়ালিটি লিমিটেড’ এর চেয়ারম্যান তামান্না শারমিন। তামান্না শারমিন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে চাকরিও করেন। ওয়াসা সূত্র থেকে কালবেলার হাতে আসে আব্দুল মজিদের ব্যক্তিগত তথ্যভাণ্ডার। সেখানে দেখা যায়, আব্দুল মজিদের স্ত্রীর নামের জায়গায় লেখা রয়েছে তামান্না শারমিনের নাম। নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘প্রিমিয়াম কোয়ালিটি লিমিটেড’ নামে তোলা প্রতিটি বিলের কাজ হয়েছে ঢাকা ওয়াসার মর্ডস সার্কেল-১ এর। আর এই একই বিভাগের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন আব্দুল মজিদ। অর্থাৎ স্বামীর সরকারি দপ্তরে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছেন সরকারি চাকরিজীবী স্ত্রী তামান্না শারমিন।
ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আব্দুল মজিদ ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তাকসিমের পরামর্শেই আব্দুল মজিদ স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ওয়াসার কাজ করাতেন। গত ৭ অক্টোবর ওয়াসা কর্তৃক গঠিত ওয়াসার কাজে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে গঠিত টাস্কফোর্সের একটি কমিটির আহ্বায়ক করা হয় এই আব্দুল মজিদকে। জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ তার এলজিইডিতে সরকারি চাকরিতে কর্মরত স্ত্রী তামান্না শারমিনের নামে ঠিকাদারি লাইন্সেস করে নিজের অফিস সার্কেলের অধীনে বিভিন্ন বিভাগে বছরের পর বছর ধরে ঠিকাদারি কাজ করেছেন, যা চরম অনৈতিক ও বেআইনি। এ ছাড়া স্ত্রীর নিজের দপ্তরের কাজ নিজেই করায় কাজও ঠিকঠাক হয়নি। একই কাজে একাধিকবার বিল তুলেছেন—অনেক কাজ না করেই বিল তুলেছেন। যেহেতু তিনিই ওই দপ্তরের, তাই বিষয়টি তদারকি করারও কেউ ছিল না। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
স্বামীর সরকারি দপ্তরে সরকারি চাকরীজীবী স্ত্রীর ঠিকাদারি কাজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। সরকারি বিধিবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তার দপ্তরে তার স্ত্রী কিংবা তিনি নিজে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতে পারেন না। এটি কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, এটি বহুমাত্রিক অপরাধ। এখানে, প্রতারণা করা হয়েছে, তথ্য গোপন করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়াসার যে প্রকৌশলী এবং তার স্ত্রী রয়েছেন তাদের দুজনকেই আইনের আওতায় আনতে হবে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার জরুরি পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল মজিদের সঙ্গে। তিনি সব শুনে কালবেলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার স্ত্রীর প্রিমিয়াম কোয়ালিটি লিমিটেড নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কি না, তাও জানি না। কে বা কারা এটা করছে কিছুই আমি জানি না।’ প্রিমিয়াম কোয়ালিটির চেয়ারম্যান তামান্না শারমিনের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মো. আফজাল হোসেন খানকে ফোন দিলে তিনি চেয়ারম্যান তামান্না শারমিনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন বলে জানালেও পরে আর ফোন ধরেননি। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আপনি বললেন—এখন আমি খোঁজখবর নেব। যদি এটা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’