
নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের কৃষক। তার ওপর বিভিন্ন স্থানে বালাইনাশকের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ভেজাল পণ্য সরবরাহ করছে। আর এতে মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। সরকারের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ল্যাব টেস্টেও এসব কোম্পানির পণ্য ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি বেসরকারিভাবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ল্যাবে করা টেস্টেও ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে এসব বালাইনাশক। তা ছাড়া চীনের রাষ্ট্রীয় একটি ল্যাবরেটরির টেস্টেও এসব পণ্যে ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও মন্ত্রণালয়ের ঢিলেঢালা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে বালাইনাশক কোম্পানিগুলো দেশব্যাপী বিস্তার করেছে প্রতারণার জাল। বিভিন্ন কোম্পানি এসব অনিয়ম এবং অপরাধের নেতৃত্ব দেয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে টেনস এগ্রো, অ্যামিনেন্স কেমিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ার্স ক্রপ সায়েন্স, এগ্রো ইনপুট বাংলাদেশ, ক্লিন এগ্রো ও নিড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। তাদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
যবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসাইন খানের নেতৃত্বে এ পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম নুর আলম এবং সেন্টার ফর সফিস্টিকেটেড ইনস্ট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরির ডেপুটি ডিরেক্টর ড. মো. ওমর ফারুক। গত ৭ জানুয়ারি এ টেস্টের ফল দেওয়া হয়।
ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার ফল বলছে, এসব বালাইনাশকে যে পরিমাণ কেমিক্যাল থাকার কথা, তার ধারেকাছেও নেই। এমনকি সর্বনিম্ন পর্যায় থেকেও অনেক কম রয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানির বালাইনাশকে প্রয়োজনের চেয়ে এক ভাগ থেকে পঞ্চাশ ভাগ পর্যন্ত কম রয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে যবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ৯টি বিষয়ে কীটনাশক পরীক্ষা করতে দিয়েছিল একটি প্রতিষ্ঠান। যবিপ্রবির ল্যাব পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক ল্যাব। পরীক্ষার ফল নির্ভুল হয়। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর থেকে এসব পণ্যে যা থাকার কথা বলা হয়েছিল পরীক্ষা করে তা পাওয়া যায়নি। প্রতিটি কীটনাশক পরীক্ষা করে দুই ভাগ, পাঁচ ভাগ, ১০ ভাগ এবং ৫০ ভাগ পর্যন্ত কম পাওয়া গেছে, যা কখনোই উপযুক্ত নয়। এটি ফসলের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক কার্যকর হবে না।
সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলা থেকে সংগ্রহ করা ১৬টি রাসায়নিক সারের নমুনা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা করে উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয়। নমুনাগুলো হচ্ছে সিনজেনটা বাংলাদেশের বিংগো (সলুবার বোরন), ফেভারিট এগ্রোর ফেবার জিঙ্ক, ইনতেফা কোম্পানির বোরফা প্লাস, প্রোগ্রেস এগ্রোর বোরো প্লাস, ফেভারিট এগ্রোর আয়াত বোরিক অ্যাসিড, স্কয়ারের জালি মনো, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ইন্ডাস্ট্রিজের বাই বোরন, ইস্পাহানি এগ্রোর মনো জিঙ্ক, ক্রপ কেয়ারের অ্যাকটিভ বোরাক্স, ভেলেন্টেটেকের ভেলেন্ট মনো জিঙ্ক, সাফা এগ্রি কেয়ারের সাবাসি এবং বোরন, গ্রিন বাংলার গ্রিন লিফ, টেনস এগ্রোর টেনস জিঙ্ক এমকোর ইকো জিঙ্ক প্রোগ্রেস এগ্রোর প্রোজিন বোল্ট, মিমপেক্সের মিম জিঙ্ক, যমুনা প্লাস এগ্রা মার্কেটের গ্রোজিঙ্ক+ এবং সিনজেনটার গ্রোজিংন। গবেষণাগারের ফলে ১৬টি নমুনার সবগুলোতেই ভেজাল পাওয়া যায়।
সাংহাই নেইপু টেস্টিং টেকনোলজি গ্রুপের ল্যাবরেটরিতে বাংলাদেশি এসব কোম্পানির পণ্য টেস্টের জন্যে পাঠায় একটি সংস্থা। সেই সংস্থার রিপোর্টেও উঠে আসে ভেজাল পণ্যের বিষয়টি। এতে দেখা যায়, চারটি কোম্পানির নমুনা পাঠানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে টেনস এগ্রো লি., নিড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, সিমবায়োসিস টেকনোলজি, অ্যামিনেন্স কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং জেনারেল এগ্রো কেমিক্যাল লিমিটেড। এসব কোম্পানির নমুনা পণ্য ল্যাব টেস্টে ভেজাল প্রমাণ পায় সাংহাই নেইপু টেস্টিং টেকনোলজি।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা থেকে ছয়টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয় মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটে। ব্যাবিলন এগ্রোর ব্যাবিলন বোরন এবং ব্যাবিলন জিঙ্ক সালফার মনো, এনতেজার এগ্রোর এন-জিঙ্ক মনো, হেকেম বাংলাদেশ লি.-এর হে জিঙ্ক, ম্যারিল্যান্ড এগ্রোর আলোক জিঙ্ক—এসব রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষায় ভেজাল হিসেবে প্রমাণিত হয়। গত ২২ জানুয়ারি মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট এ প্রতিবেদন দেয়।
কালবেলার প্রতিনিধি সরেজমিন চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখেছেন, সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ২০ জন পেঁয়াজ চাষি তাদের পেঁয়াজ ক্ষেতে মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ উৎপাদিত য়োকরাল নামক ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। এর ফলে তাদের প্রায় ৩০ বিঘা জমির পেঁয়াজ পচে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও বেশকিছু রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের নমুনা সংগ্রহ করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা। প্রায় সব পরীক্ষায়েই এসব কীটনাশক ভেজাল প্রমাণিত হয়। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি বালাইনাশক এবং কীটনাশকের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ভেজাল বালাইনাশক সরবরাহের অভিযোগ প্রমাণিত। এরপরও অদৃশ্য কারণে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম সাইদুজ্জামান নেতৃত্বেই এসব ভেজাল কীটনাশকের বাজার চলছে। এর মধ্যে সভাপতি সহিদুজ্জামানের কোম্পানি মিমপেক্সের বিভিন্ন কীটনাশকের নমুনায়ও ভেজাল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান পাঠানের টেনস এগ্রোর বিভিন্ন নমুনায়ও ভেজাল পাওয়া গেছে পরীক্ষাগারে। তথ্য বলছে, ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে পতিত সরকারের বিদায়ের পরে মেহেদী হাসানকে সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়। এর পেছনে কলকাঠি নাড়েন সাইদুজ্জামান। মেহেদী হাসানকে সাধারণ সম্পাদক বানানো হলেও তিনি আগে এ সমিতির সদস্যই ছিলেন না।
মিমপেক্সের বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগও দিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন লিখিতভাবে এ অভিযোগ দেন। এতে বলা হয়, মিমপেক্স এগ্রো কেমক্যিাল কোম্পানিসহ একটি চক্র বালাইনাশক আইন ও আমদানি নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সিন্ডিকেট করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। মানহীন পণ্য আমদানিতে সক্রিয় রয়েছে।
ক্যাবের অভিযোগের বিষয়টি আমলে নিয়ে অবৈধ উৎস থেকে পণ্য আমদানি করার প্রমাণ পায় কাস্টমস। পরে কোম্পানিটিকে গত বছর ৪ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কোনোরকম তদন্ত কিংবা পণ্য ল্যাবে টেস্ট না করেই দায়মুক্তি দেয় কোম্পানিটিকে।
এ ছাড়া জনস্বার্থে লিগ্যাল এরা নামের একটি প্রতিষ্ঠান মিমপেক্সের ভেজাল পণ্য নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট করে। এটি আমলে নিয়ে আদালত কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্লিপ্ততাকে দায়ী করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম কালবেলাকে বলেন, কীটনাশক পরীক্ষা ও বাজারজাত করা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কোনো কোম্পানি যদি ভেজাল কীটনাশক বাজারজাত করে, প্রমাণ পেলে সেগুলো নিষিদ্ধ করে দিই বা বাজার থেকে সরিয়ে ফেলি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের আমদানির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়।