
থামছে না ‘মব ভায়োলেন্স’। পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক আক্রোশ থেকে অথবা ঐ ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির অর্থসম্পদ লুটপাট করাই থাকে মূল লক্ষ্য। এরপর চলে হামলা, লুটতরাজ, গণপিটুনি ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। একের পর এক চলতে থাকা এ ধরনের ঘটনাকে ‘মব জাস্টিসে’র নামে দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অনেকেই এটাকে ‘মব জাস্টিস’ বলছেন। আসলে এই ধরনের শব্দ ব্যবহারে দায়মুক্তির সুযোগ তৈরি হয়। এটাকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলা হয়। এটা থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। ফলে এটাকে অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। সেই অপরাধের সঙ্গে যতজনই যুক্ত থাকুক না কেন তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
গত এক সপ্তাহ ধরে সারা দেশে মব ভায়োলেন্সের নামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, গণপিটুনি ও মানুষ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ ঘটেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কঠোর ভাষায় সতর্ক করে জানিয়েছে, ‘কেউ যেন কোন পরিস্থিতিতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। কোথাও কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী থানাকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। মবের প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।’
অন্যদিকে নাম ভাঙিয়ে তল্লাশি-অর্থ দাবির বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। দুদকের কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বাসায় তল্লাশি চালিয়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা অর্থ দাবি করার অভিযোগ পেয়েছে দুদক। কারো সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা বা দুদকের নাম ভাঙিয়ে তল্লাশি-অর্থ দাবির ঘটনা ঘটলে দুদকের টোল ফ্রি হটলাইন ১০৬ নম্বরে অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর আহ্বান জানিয়েছে কমিশন।
গুলশানে সাবেক এমপির স্ত্রীর বাসায় লুটপাট :সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর গুলশান-২ নম্বর সার্কেলের ৮১ নম্বর রোডের একটি বাড়ির চতুর্থ তলায় মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে হামলা চালায় একদল লোক। ঐ বাসায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ, অস্ত্র ও আওয়ামী লীগের দোসরদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে; এমন তথ্যের ভিত্তিতে মধ্যরাতে দরজা ভেঙে ‘তল্লাশির’ নামে ২০-২৫ জন লোক ঢুকে পড়ে। তল্লাশির অজুহাতে সেখানে প্রবেশ করে বাসাটি তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা করে তারা। ৯৯৯-এর মাধ্যমে খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে আসে গুলশান জোনের ডিসি, গুলশান থানার ওসিসহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেখান থেকে শাকিল খন্দকার (২৪), জুয়েল খন্দকার (৪৮) ও শাকিল আহমেদ (২৮) নামে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় ঐ বাড়ির কেয়ারটেকার আব্দুল মান্নান বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা করেছেন।
দাদা-নাতি ইরানি নাগরিকের ওপর হামলা :রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মঙ্গলবার দুপুরে ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ইরানি নাগরিককে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয় জনতা। পরে পুলিশ খবর পেয়ে আহত ঐ দুই ইরানি নাগরিককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তারা হলেন—আহমেদ (৭৪) ও তার নাতি মেহেদী (১৮)।
ভাটারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুজন হক জানান, মারধরের শিকার ঐ দুজন সম্পর্কে দাদা ও নাতি। তাদের মধ্যে একজন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি, আরেক জন গত ১ মার্চ বাংলাদেশে আসেন। তারা বনানীর সুইচ হোটেলে উঠেছেন। মঙ্গলবার দুপুরে তারা মানি একচেঞ্জ করার জন্য বসুন্ধরা এলাকায় গিয়েছিলেন। তাদের কারেন্সি দিয়ে তারা টাকা নিচ্ছিলেন। এ সময় পাশে থাকা লোকজন ভুল ভেবে তাদের ‘শয়তানের নিঃশ্বাস গ্রহণ করিয়ে’ প্রতারণাকারী বলে সন্দেহ করে। একপর্যায়ে তারা ভয় পেয়ে নিজেদের গাড়িতে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় লোকজন তাদের ধাওয়া দেয়। এতে তাদের গাড়ির চাপায় কয়েক জন রিকশাচালক আহত হন। এরপর তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি দেয় লোকজন। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। হামলার ঘটনায় পুলিশ দুই জনকে আটক করেছে।
পতেঙ্গায় পুলিশের ওপর হামলা :গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মব তৈরি করে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা আউটার রিং রোডে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইউসুফ আলীর ওপর হামলা করা হয়। হামলাকারীরা তার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ এবং ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নেয়। খবর পেয়ে সৈকত এলাকায় টহলরত পতেঙ্গা থানা পুলিশের একটি দল ও আশপাশের লোকজন গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ১২ জনকে আটক করা হয়েছে।
সাতকানিয়ায় জামায়াতের দুই কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা :চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত ঢুকেছে’ বলে মব তৈরি করে দুই যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। পিটুনিতে গুরুতর আহত দুই যুবক পরে মারা যান। নিহতরা হলেন—মো. নেজাম উদ্দিন ও আবু সালেক। তারা সাতকানিয়ার কাঞ্চনা ইউনিয়নের বাসিন্দা। নিহত নেজাম ও সালেককে নিজেদের কর্মী দাবি করে জামায়াতে ইসলামী সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের সেক্রেটারি জায়েদ হোসেন বলেন, দুজনই কাঞ্চনা ইউনিয়ন জামায়াতের কর্মী। তাদের পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।
এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে উলটো করে বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভারব্রিজের রেলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা যা বলেন:মব ভায়োলেন্সের নামে এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কেন বেড়ে গেছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক মো. তৌহিদুল হক বলেন, যে ঘটনা এখন ঘটছে, তা আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা এবং অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। এটা প্রতিরোধে পুলিশও সক্রিয় নয়। তারা যেন ছেড়ে দিয়েছে। আর এই পরিস্থিতির শিকার হতে পারে নিরীহ মানুষও। সুযোগসন্ধানী এবং অপরাধীরা নানা গুজব রটিয়ে মব সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করতে হবে। অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর যারা মব সৃষ্টি ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
রাজনৈতিক নেতারা যা বলেন: জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সিনিয়র সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেন, ‘ছাত্র-জনতা’ অথবা ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে কিছু দুর্বৃত্ত দেশব্যাপী ডাকাতি, লুটপাট ও দখলদারিতে জড়িত হয়ে পড়েছে। কখনো এরা রাজনৈতিক দলের পরিচয় ব্যবহার করছে এবং কখনো এরা ভাড়ায় সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ড করতে যাচ্ছে। এদেরকে কঠোর হস্তে দমন করার আহ্বান জানাচ্ছি। অপরাধীদের পরিচয় একটাই সেটা হলো অপরাধী।’
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান :গত ছয় মাসে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ ৫০ শতাংশ বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে সারা দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৯টি বেশি (৬৯ শতাংশ)। ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় গত ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ২৩০টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৫টি (৭০ শতাংশ) বেশি। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে জানুয়ারি মাসে ৩৬টি হত্যা, ৫৪টি ছিনতাই, ১৪৬টি চুরি এবং আটটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ দাবি করছে এই সময়ে তারা ঢাকা শহর থেকে ৭১৯ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে। এই পরিস্থিতিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টায় নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সেখানে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতির আশ্বাস দেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। সংস্থাটির হিসেব আরো জানাচ্ছে, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান ৯৫৪ জন। আসকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় ১২৮ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে ৫১ জন নিহত হয়েছিলেন।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন। গতকাল বুধবার সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সম্প্রতি গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ডাকাত, চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসবের বাইরে ধর্মীয় অবমাননা এবং ছেলেধরার অভিযোগেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। গণপিটুনির ঘটনায় থানায় মামলা হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় না আসায় এ ধরনের ঘটনা থামছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, মব ভায়োলেন্স কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। যদি অপরাধীও হয়, তাকে পুলিশের হাতে দিতে হবে। যারা এত জড়াচ্ছেন, তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সবাইকে আমরা আইনের আওতায় আনছি।
সুনামগঞ্জে জলমহাল থেকে ‘৪ কোটি’ টাকার মাছ লুট
দিরাই (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও সুনামগঞ্জে লুটপাট থামেনি। প্রকাশ্যে গত পাঁচ দিনে জেলার দিরাই ও শাল্লা উপজেলার সাতটি জলমহালের প্রায় ‘৪ কোটি টাকা’র মাছ লুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জলমহালের ইজারাদাররা জানিয়েছেন, জলমহালের আশপাশের অন্তত ১০-১৫টি গ্রামের ৮-১০ হাজার মানুষ আনন্দ-উল্লাসে বিলের মাছ লুট করে নিয়ে গেছে। পুলিশকে জানিয়েও মাছ লুট আটকানো যায়নি। কয়েক হাজার মানুষ একসঙ্গে জড়ো হওয়ায় প্রতিহত করাও সম্ভব হয়নি। পবিত্র রমজান মাসে এমন কাজ করা ঠিক না বলায়, শাল্লার আটগাঁও গ্রামের রনি বিল্লালের বসতঘর, অটোরিকশা ভাঙচুর করে মোটর ও ব্যাটারি খুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার ছোট ভাইয়ের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে বলে জানিয়েছেন রনি বিল্লাল। এমন ঘটনায় আতঙ্কে আছেন হাওর অঞ্চলের জলমহাল ইজারাদার ও সংশ্লিষ্টরা।