Image description

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বেড়েছে ডাকাতি ও ছিনতাই। শুধু রাতেই নয়, দিনদুপুরেও সড়কে যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে, গাছ ফেলে হানা দিচ্ছে ডাকাতরা। যাত্রীদের মারধর করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। কয়েক দিনের ব্যবধানে একাধিকবার শুধু ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারে একই স্থানে দিনেদুপুরে যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় পরিবহনের যাত্রীসহ সাধারণ মানুষে মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সড়কে ডাকাতির কারণে আসন্ন ঈদে পরিবহন খাতে অর্ধেক বাজার হারানোর আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। ফলে সড়ক-মহাসড়কে নিরাপত্তায় প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিচ্ছে— তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নিষ্ক্রিয়তা’ ও ‘ঢিলেঢালা টহল ব্যবস্থার’ কারণেই ডাকাতি বাড়ছে বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ডাকাত-আতঙ্কে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ক্রমেই দূরপাল্লার যাত্রীও কমছে বলে দাবি করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

 

আর হাইওয়ে পুলিশ বলছে, নানান সীমাবদ্ধতা থাকার পরও মহাসড়কে নিরাপত্তা বাড়াতে এরইমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগসহ জনবল বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে হাইওয়ে থানার পাশাপাশি জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে সড়কগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

 

তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ‘পুলিশ টাউন’ এলাকায় ‘শুভযাত্রা পরিবহন’-এর একটি বাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে বাসের তিন যাত্রী আহত হন। এর ১৫ দিন পর গত ২ মার্চ একই স্থানে দিনেদুপুরে আরেকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

 

ওই ঘটনার ভুক্তভোগী বাসযাত্রী নাজমুল হোসেন জানান, দুপুরে আশুলিয়ার শ্রীপুর থেকে ‘রাজধানী পরিবহন’-এর একটি বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। বাসটি ২০-২৫ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পুলিশ টাউন এলাকায় থামলে ডাকাতের কবলে পড়ে। এ সময় পাঁচ থেকে ছয় জন ডাকাত দেশীয় অস্ত্রের মুখে বাসের যাত্রীদের মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়। ডাকাতরা তার মোবাইলটিও ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে পালিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, ‘দিনেদুপুরে চলন্ত বাসে ডাকাতি শিকার হলাম। দিনের বেলায় বাসে উঠে ছিনতাই করছে, এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।’

এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোর সোয়া ৪টার দিকে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে শিক্ষা সফরের চারটি বাস ডাকাতির কবলে পড়ে। এসময় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে নাটোরের একটি পার্কের উদ্দেশে যাচ্ছিল শিক্ষা সফরের দলটি। সড়কে গাছ ফেলে ডাকাত দল বাসগুলোতে থাকা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুঠোফোন, টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) ফোন করায় পুলিশ এসে পড়ায় পালিয়ে যায় ডাকাতরা। এ ঘটনায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ঘাটাইল উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

তার আগে দেশজুড়ে আলোচিত হয় ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ‘ইউনিক রয়েল আমরি ট্রাভেলস’ নামক বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের ওপর যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। বাসটি ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিল।

বাসের যাত্রীদের ভাষ্যমতে, ওই দিন রাত ১১টায় ঢাকার গাবতলী থেকে বাসটি ছাড়ে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাসটিতে ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ধরে বাসটিকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে ডাকাতি ও দুই নারীর শ্লীলতাহানি করে ডাকাত দল। এ ঘটনায় মূল হোতাসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিককালে ডাকাতি ও দস্যুতার (ছিনতাই) ঘটনায় মামলা বেড়েছে। গত আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪৫টি, যা ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের তুলনায় ৩৮২টি বেশি (৫০ শতাংশ)।

প্রতি বছরে দুই ঈদে দিনাজপুরে নিজ গ্রামে যান বেসরকারি চাকরিজীবী রবিউল ইসলাম। যাত্রাপথে বাসে দীর্ঘ সময় তাকে কাটাতে হয়। সাধারণত রাতেই রওনা হন ঢাকা থেকে। পৌঁছেন ভোরে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দিনের বেলায়ই যদি সড়ক নিরাপদ না থাকে, রাতের বেলায় তো আরও বিপদ। তাহলে যাত্রাপথে ভয় থেকে যায়। আমি বেশিরভাগ সময় রাতেই রওনা করি। সড়কে নিরাপত্তা বাড়ানো জরুরি।

ঢাকা থেকে সাভার অভিমুখী সাভার পরিবহনের বাসচালক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ইদানীং বাসে ডাকাতি হচ্ছে শুনছি। সামনে ঈদের বাজার। আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে গাড়ি চালাতে চাই। সড়কে নিরাপত্তা বাড়ালে আমাদের জন্য ভালো হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডাকাতি-ছিনতাই হচ্ছে শুধু মহাসড়কেই না। এই ঘটনাগুলো জেলা, থানা পর্যায়ে ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কেও হচ্ছে। ফলে এসব পথে চলাচল করা যাত্রীদের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে। যার কারণে ক্রমেই যাত্রীর সংখ্যাও কমে আসছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। খোঁজ-খবর নিয়েছি। সড়কেও এখনও পুলিশ সক্রিয় হতে পারেনি। এ কারণে এবার ঈদ কেন্দ্র করে এ সেক্টর অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ধাক্কার মুখোমুখি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঈদে ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজার আছে এ সেক্টরে। সেটি নেমে ৩০ কোটি হাজার অর্থাৎ অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।

হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি (অপারেশনস উত্তর বিভাগ) ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদের আগে মহাসড়কে যানজটে যাত্রীদের ভোগান্তি আমরা দেখেছি। তবে এবার যেটা হচ্ছে মহাসড়কে অপরাধ বেড়েছে। ৫ আগস্টে পর পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের পাশাপাশি হাইওয়ের পুলিশও নানা সংকটে মুখে পড়েছে। সীমাবদ্ধতার মধ্যে এখনও দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আমাদের সদস্যদের। আমাদের গাড়ির সংকট রয়েছে। ফোর্সের সংখ্যাও কম।’

সারা দেশে ৮ হাজার কিলোমিটার সড়কে হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর বিপরীতে আমাদের ফোর্সের সংখ্যা মাত্র আড়াই হাজার। সীমিত সংখ্যক বাহিনী নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যে ফোর্সের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বলেছি। পাশাপাশি প্রতিটি হাইওয়ে থানা ও জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে। সে ব্যবস্থাগুলো আমরা নিচ্ছি।’