
অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড গত কয়েক বছরে হাতিয়ে নিয়েছে শতকোটি টাকা। এই অর্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। যার ভাগ পেয়েছেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীসহ কর্মকর্তারাও। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার নম্বরপত্র, মূল সনদ, স্বাক্ষর এসবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে আসছে বোর্ডগুলো। এসএসসি ১২ ও এইচএসসিতে সরকার নির্ধারিত ফি ২২ টাকা। কিন্তু বোর্ডগুলো এসএসসিতে নেয় ১৫০ টাকা ও এইচএসসিতে ২০০ টাকা। গত ১০ বছরে এই সিন্ডিকেট গড়ে বোর্ডগুলো হাতিয়ে নিয়েছে শত কোটি টাকা। দেশে বিদ্যমান ১১ বোর্ডের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী বোনাসের নামে এই বাড়তি অর্থ পকেটে পুরেছেন।
সম্মানীর ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশের তোয়াক্কা করেনি বোর্ডগুলো। এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অর্থ কমিটির অনুমোদন নিয়েই সম্মানী কাগজে-কলমে দেখিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতো। আর এই অবৈধ অর্থ তারা ‘বোনাস’ বলে চালিয়ে নিতেন। একইভাবে দুর্নীতি হয়েছে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের পাশাপাশি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডেও। কারিগরি এর জন্য অর্থ নিতো ২০০ ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ১৩৫ টাকা।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, এসএসসি ও এইচএসসি’র প্রতি মূল সনদ লেখা, যাচাই, স্বাক্ষর ও পাঠানো বাবদ বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানী ৬ টাকা। এ ছাড়াও এসএসসি’র একজনের নম্বরপত্র লেখা, যাচাই, স্বাক্ষর ও পাঠানো বাবদ ১২ টাকা ৫০ পয়সা ও এইচএসসি’র নম্বরপত্র প্রতি ২২ টাকা সম্মানী নির্ধারণ করা হয়। ২০০৩ সাল থেকে এই সম্মানী নির্ধারণ করা হয়। এরপর থেকে এই অর্থের পরিমাণ আর বাড়ানো হয়নি। সরকার থেকে বাড়ানো না হলেও ২০১৩/১৪ সাল থেকে বোর্ডগুলো নিজেদের মধ্যে যোগসাজশে নতুন এই অর্থ নির্ধারণ করেন। দেশে বিদ্যমান ১১টি শিক্ষা বোর্ড। এর মধ্যে সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ড হলো- ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, সিলেট, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড।
অভিযোগ রয়েছে- এসব বোনাসের ভাগ যেমন পেতেন প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিক তেমনি একটা অংশ যেতো খোদ শিক্ষামন্ত্রীর হাতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড থেকে অবসরে যাওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, এই অর্থের একটা অংশ যেতো শিক্ষামন্ত্রীর হাতে। বছরে বিভিন্ন সেক্টরের জন্য অন্তত ছয়টি থেকে আটটি বোনাসের মাধ্যমে এই অর্থ ভাগ হতো। তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আরেক কর্মকর্তার ভাষ্যতেও। তিনি বলেন, সম্মানীর টাকা বোর্ডের অফিস সহায়ক থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান পর্যন্ত সবাই পান। প্রতি বছরে একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এক লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। আর যার একটি অংশ যায় শিক্ষামন্ত্রীর হাতেও। আগে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ১০ থেকে ১২ শতাংশ। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ডা. দীপু মনি আসার পর এই অর্থের পরিমাণ হয় ২০ শতাংশ।
২০২২-২৩ বর্ষে অতিরিক্ত আয়ের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অতিরিক্ত ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা ভাগাভাগি করে নেয় ৯টি সাধারণ বোর্ড। মূল সনদ থেকে অতিরিক্ত আয় ছিল ৯ কোটি ৮ লাখ টাকা এবং নম্বরপত্রে ৩ কোটি ২ লাখ টাকা। এই বছরের নম্বরপত্রের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আয় হয় প্রায় তিন কোটি টাকা। এই হিসেবে গত ১০ বছরে ১০০ কোটি টাকার উপরে আয় করেছে বোর্ডগুলো। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মূল সনদ ও নম্বরপত্রের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত সম্মানীর চেয়ে বেশি অর্থ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সবগুলো শিক্ষা বোর্ড থেকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে বোর্ডপ্রধানদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির অনুমোদন ও বোর্ডের অর্থ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষেই এই অর্থ নেয়া হয়েছে। এই অতিরিক্ত অর্থগুলো আলাদা নিয়ম তৈরি করে বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সরকারি কাগজেই গ্রহণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সদ্য সাবেক অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, শিক্ষার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। তারা এটাকে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিলেন। এর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি কাঠামো প্রস্তুতে কাজ করছে। যে কাঠামোর মধ্যে বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতিরিক্ত কাজ করলে সেই অনুযায়ী সম্মানী পাবেন।