
কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফ্যাসিবাদ সরকারের দোসর হিসাবে পরিচিত ভিআইপি বন্দিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, কারা কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে বন্দিদের আরাম-আয়েশে রাখার ব্যবস্থা করছেন। জেল কোড ভেঙে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিচ্ছেন। অবৈধভাবে বাইরে থেকে রান্না করা খাবার প্রবেশ করানো হচ্ছে কারা অভ্যন্তরে। বিশেষ করে সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, শাহজাহান খান এবং পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসা থেকে রান্না করা খাবার নির্বিঘ্নে কারাগারে ঢুকেছে জেলারের সহযোগিতায়। এ ঘটনায় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া কারাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও অনেক অভিযোগ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার একেএম মাসুমের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি হলেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ-আল মামুন এবং কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারের জেলার সর্বোত্তম দেওয়ান। ৪ ফেব্রুয়ারি গঠিত এ কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন ডিআইজি (প্রিজন্স) জাহাঙ্গীর কবির। কিন্তু সোমবার পর্যন্ত তদন্ত কমিটি তাদের সরেজমিন কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছে প্রায় ৯ হাজার। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে সাবানের জন্য প্রতিমাসে ৫০ টাকা করে বরাদ্দ আছে। বরাদ্দ রয়েছে হারপিক। দেওয়ার কথা ৫০ গ্রাম করে সরিসার তেল। জামিনপ্রাপ্ত গরিব বন্দিদের যাতায়াত ভাতাও কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়ার কথা। কিন্তু এসব না দিয়ে এ সংক্রান্ত মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বন্দিদের জরুরি সেবার জন্য যে পিকআপ রয়েছে, তা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি স্থাপনার ভেতর গাছপালা কাটতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু অনুমতি না নিয়ে সম্প্রতি কারা কম্পাউন্ডের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে অনেক গাছপালা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এতে বেশ কয়েকটি বৈদ্যুতিক খুঁটি পুড়ে যায়। এ কারণে ঝুঁকিতে পড়েছেন বন্দিরা। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে আগুন আতঙ্ক।
সূত্র আরও জানায়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের তুলনামূলক ভালো ওয়ার্ড-সূর্যমুখী, বনফুল, শাপলায় ‘জামাই আদরে’ রাখা হয়েছে। কারাগারে থাকা অবস্থায় আসামিদের টাকাপয়সা জমা রাখা হয় পার্সেস কার্ডের (সিপি) মাধ্যমে। কিন্তু জামিন হওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই ওই টাকা ফেরত দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রেও মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়। কারাবিধি অনুযায়ী, মোবাইল ফোনে বন্দিরা সপ্তাহে একবার সর্বোচ্চ ১০ মিনিট কথা বলতে পারেন স্বজনদের সঙ্গে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে বন্দিরা কথা বলছেন যখন-তখন। এ কক্ষে প্রতি মিনিট ১০০-২০০ টাকাও নেওয়া হচ্ছে বলে কারা অভ্যন্তরের সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নানা কাজে কারাবন্দি আওয়ামী লীগ নেতাদের টাকা তুলতে হয় ব্যাংক থেকে। এক্ষেত্রে বাইরে থেকে লোক মারফত চেক সই করিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে চলছে রীতিমতো বাণিজ্য। কেবল তাই নয়, এইচটি ইমামের ছেলে তানভির ইমাম, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নাসা গ্রুপ ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারকে অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে ৪৪ দিন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার সন্ধ্যায় ডিআইজি (প্রিজন্স) জাহাঙ্গীর কবির যুগান্তরকে বলেন, যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো একেবারেই ডাহা মিথ্যা ও ভুয়া প্রচারণা। যারা অতীতে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, তারাই এসব ছড়াচ্ছে। এটি একটি বাজে বিষয়। একজন কারাবন্দির খাবারও বাইরে থেকে নেওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু অভিযোগ এসেছে, তাই নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত করতে হয়। এ কারণেই কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তানভীর ইমাম, আসাদুজ্জামান নূর ও নজরুল ইসলাম মজুমদার কতদিন বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ছিলেন, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে বেশ কয়েকটি চিঠির বিনিময়ে তাদের হাসপাতাল থেকে এরই মধ্যে কারাগারে ফেরত আনা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য সর্বোত্তম দেওয়ান বলেন, এখনো আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করতে পারিনি। শিগ্গিরই সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করব। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতিবেদন দাখিল করব।