
অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর এবং চিলমারী নৌবন্দরে আমদানি করা পণ্যের পরিমাণ কম দেখিয়ে শুল্কফাঁকি চলছে। রাজস্ব কর্মকর্তা, সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং আমদানিকারকদের যোগসাজশে ভারত থেকে আমদানি করা কয়লা ও পাথরে এসব শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে এমন তথ্যের সত্যতা মিলেছে। এছাড়াও সম্প্রতি সোনাহাট স্থলবন্দরে অভিযান চালিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিম।
এদিকে, চিলমারী নৌবন্দরে কয়লা আমদানিতে নজিরবিহীন দুর্নীতির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির সাথে মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভারত থেকে থার্ড কান্ট্রি ডিক্লারেশনে আসা কয়লাবোঝাই বাল্কহেড বাংলাদেশের চিলমারী বন্দরে নোঙ্গর করার পর নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নতুন আরেকটি লেটার অব ক্রেডিটের (এলসি) বিপরীতে পণ্য খালাস দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। অভিযোগের সত্যতা স্বীকারও করেছেন সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা।
সোনাহাট স্থলবন্দর সূত্র জানায়, এই স্থলবন্দর পথে এলসির মাধ্যমে ভারত থেকে নিয়মিত পাথর ও কয়লা আমদানি করা হয়। প্রতিটি এলসিতে ঘোষণা দেওয়া পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আসে। আমদানি করা অতিরিক্ত পণ্যের শুল্ক সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ভাগ করে নেওয়া হয়। কাস্টমস বিভাগ, সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং আমদানিকারক-এই তিন পর্যায়ে এই ভাগবাটোয়ারা চলে। পুরো বিষয়টি তদারকি করেন সংশ্লিষ্ট এলসির সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট।
সোনাহাট স্থলবন্দর ও চিলমারী নৌবন্দর পথে পণ্য আমদানিকারী একাধিক আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ব্যবসায়িক নিরাপত্তার স্বার্থে কেউ গণমাধ্যমে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।
আমদানিকারকরা জানান, প্রতিটি এলসিতেই ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি হয়। ঘোষণা অনুযায়ী আসা পণ্যের শুল্ক রাজস্ব খাতে জমা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত পণ্যের যে শুল্ক হয় তার সিকিআনাও সরকারের ঘরে যায় না। অতিরিক্ত পণ্যের শুল্কের মোট পরিমাণের অর্ধেক নেন রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাকি টাকা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকের মধ্যে ভাগ হয়।
সোনাহাট স্থলবন্দর সংশ্লিষ্ট এক আমদানিকারক বলেন, ‘ প্রত্যেক এলসিতেই ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আসে। পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। কোনও এলসিতে যদি অতিরিক্ত পণ্যের শুল্ক ৪ লাখ টাকা হয় তাহলে এর অর্ধেক পায় কাস্টমস। বাকি অর্ধেকের ২০ বা ৩০ ভাগ পান সিএন্ডএফ এজেন্ট। তবে এটা নির্ভর করে আমদানিকারকের ধরণের ওপর।’
ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানির এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সোনাহাট স্থলবন্দরে অভিযান চালায় দুদকের এসফোর্সমেন্ট দল। অভিযান শেষে ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া সংবাদ বিবরণীতে দুদক জানায়, ‘ সোনাহাট স্থলবন্দরে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে যোগসাজশে আমদানিকৃত পাথর ও কয়লা পরিমাণ কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। নথিপত্রের প্রাথমিক পর্যালোচনায় অভিযোগের সত্যতা রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।’
এদিকে চিলমারী নৌবন্দর পথে ভারতীয় কয়লা আমদানিতে নজিরবিহীন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। গত জানুয়ারি মাসে থার্ড কান্ট্রি (মালয়েশিয়া) ডিক্লারেশন দিয়ে ভারতের ধুবরি থেকে চিলমারী নৌবন্দরে ৪ হাজার মেট্রিকটন কয়লা আমদানির এলসি করেন নর্থ বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ নামে এক আমদানিকারক। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ছিল মেসার্স সোনালী ট্রেডার্স। ওই এলসির বিপরীতে গত ১৪ জানুয়ারি এমবি মেহেতাব-তাহাসিন-১ নামে বাল্কহেড ১২৫ মেট্রিকটন এবং এমবি মতিন বাল্কহেড ১১৫ মেট্রিকটন কয়লা নিয়ে চিলমারীর কাঁচকোল নৌ বন্দরে ভিড়ে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের চিলমারী নৌবন্দর পাইলট তুষার ১৪ জানুয়ারি কয়লাবোঝাই দুটি বাল্কহেড বাংলাদেশ জলসীমায় প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
থার্ড কান্ট্রি ওই এলসিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও রেফারেন্স ছিল না। ব্যাংকের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) না পাওয়ায় পণ্য খালাসের অনুমতি দেয়নি কাস্টমস। মানি লন্ডারিং আইনের ঝামেলা এড়াতে কয়লাবোঝাই দুটি বাল্কহেড বন্দরে একমাস বসিয়ে রেখে ওই কয়লার বিপরীতে একই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ব্যাংক রংপুর শাখার মাধ্যমে ৩৫০ মেট্রিকটনের আলাদা আরেকটি এলসি করেন ওই আমদানিকারক। কাস্টমস ও সিএন্ডএফ এজেন্টের যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নজিরবিহীন এই কারচুপি করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রায় দেড় মাস বন্দরে আটকা থাকার পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আটকে থাকা বাল্কহেড দুটি নতুন এলসির বিপরীতে চিলমারী বন্দর থেকে ছাড়পত্র দেয় কাস্টমস। পরে একই এলসিতে পদ্মা-২ নামে আরেকটি বাল্কহেড ১১০ মেট্রিকটন কয়লা নিয়ে বন্দরে ভিড়লে সেটারও ছাড়পত্র দেয় কাস্টমস।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে আমদানি পণ্য পৌঁছার পরে এলসি করার এমন ঘটনা নজিরবিহীন। এখানে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই তিনটি বাল্কহেডের প্রতিটিতে ঘোষণা দেওয়া পরিমাণের চেয়ে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ টন করে বেশি কয়লা আনা হয়েছে। যোগসাজশে সেই শুল্কও ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
পুরো বিষয়টি স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ আপনি যে বিষয়টি বলছেন সেটা আমার অথরিটি জানে। আমদানিকারক আগে করা এলসির ব্যাংক এনওসি দিতে পারেনি। এজন্য তারা পরে আবার এলসি করেছে।’
এলসির কাগজপত্র চাইলে এই রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন, ‘ এখন সেগুলো নিয়ে কী করবেন। ওটার তো ডিউটি ট্যাক্স আদায় করা হয়েছে। যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আর ইয়ে করার দরকার নাই। আপনি বললে আমি আমদানিকারককে বলি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে।’
এলসিতে উল্লেখ করা পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণ কয়লা আসা প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, ‘ কিছু হয়তো বেশি আসতে পারে। এটা হয়। তবে আহামরি বেশি আসেনি।’
‘এমনিতেই বন্দরটির অবস্থা খারাপ। নিউজ করলে আরও শেষ হবে। নিউজ টিউজ করার দরকার নাই।’ নজিরবিহীন অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন রাজস্ব কর্মকর্তা মিজান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কুড়িগ্রাম সার্কেলের সহকারী কমিশনার নার্গিস আক্তারের সাথে কথা বলতে একাধিক দিন তার কার্যালয়ে গিয়েও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।
বন্দরে অনিয়মের প্রশ্নে কমিশনারেট রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. জিয়াউর রহমান খান বলেন, ‘এটা আমার একটু জেনে বলতে হবে।’