
স্বৈরাচার হাসিনা ভারতে পলায়নের পর নানামুখী ষড়যন্ত্রে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি বর্তমান সরকারের জন্য আশার আলো। রেমিট্যান্সে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তি দিলেও মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, বাজেট বাস্তবায়ন, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার ও বিদেশি বিনিয়োগের অবনতি হয়েছে। থমকে আছে বিভিন্ন খাতের ব্যবসা। এই হাওয়া লেগেছে অবকাঠামো তথা নির্মাণ খাতের রড-সিমেন্ট শিল্পেও। বিগত সরকারের সময়ে নেয়া একাধিক মেগা প্রকল্পকে কেন্দ্র করে রমরমা ব্যবসা করতেন রড-সিমেন্ট শিল্পের ব্যবসায়ীরা। পট পরিবর্তনের পর বন্ধ হয়ে গেছে বিগত সরকারের নেয়া অনেক প্রকল্প। এছাড়া গত প্রায় ১৬ বছরের একচেটিয়া শাসনব্যবস্থার ফলে দেশের মধ্যে সরকার সমর্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাদের বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করতেন। বর্তমানে সে সবের কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন রড-সিমেন্ট শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন কিন্তু উৎপাদন অনেকটা বন্ধের পথে হওয়ায় খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে প্লট-ফ্ল্যাট দেখিয়ে ঋণ নিয়েছেন কিন্তু নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় তারাও বিপাকে আছেন। যার প্রভাব পড়ছে ব্যাংকখাতে। ব্যাংকগুলো ঋণের টাকা ফেরত পাবে কিনা এ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছে। তাদের মতে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে রড-সিমেন্ট শিল্প খাত। নির্মাণশিল্পের এ খাতের ভরা মৌসুমেও ক্রেতাদের কাছ থেকে আসছে না কাঙ্খিত সাড়া। ফলে চাহিদা ও উৎপাদনের দুটো গ্রাফই এখন নি¤œমুখী। শুধুমাত্র সরকারের উন্নয়ন কাজই বন্ধ নয়; গ্রাম-গঞ্জে মানুষের হাতেও অর্থ নেই। গ্রামীণ ঘর-বাড়ি নির্মাণও অনেকটা স্থবির। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রডের দাম গত এক বছরে প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। এদিকে আমেরিকা, কানাডা, দুবাই অনেক উন্নত দেশে অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দিচ্ছে। তাই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ না মিললে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের অনুসারী যারা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা বিনিয়োগের সুযোগ না পেলে বিদেশে পাড়ি জমাবেন। টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব নিবেন। যা দেশের অর্থনীতির জন্য আগামীদিনে বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। তাই আবাসনখাতে সরকারের নীতি সহায়তা চালুর দাবি জানিয়েছেন অনেকে। অথবা এই খাতে বিনাশর্তে কালো টাকা বিনিয়োগ, নির্মাণশিল্প সংশ্লিষ্ট পণ্যে করারোপ বাতিল এবং স্বল্প সুদের বিশেষ ঋণ তহবিল গঠন করার কথা বলেছেন।
ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকারি-বেসরকারি বড় এবং মাঝারি নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ থাকায়, নতুন করে প্রকল্প শুরু না করার প্রভাব পড়েছে এ খাতে। এ অবস্থা চলতে থাকলে চরম সংকটে পড়বে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী ও উৎপাদকেরা বলছেন, নির্মাণ খাতের প্রধান উপকরণ রডের দাম গত বছর লাখ টাকা ছাড়িয়েছিল। এই বছরের পটপরিবর্তনে পরপর অবকাঠামো খাতে ধীরগতি দেখা দেয়। তাতে কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাধ্য হন উদ্যোক্তারা। রডের মতো চাহিদা কমছে নির্মাণের আরেক বড় উপকরণ সিমেন্টের। উদ্যোক্তাদের দাবি, রড ও সিমেন্ট এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তার চেয়ে আর কমার সুযোগ নেই। কারণ, নতুন করে ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবং বাড়তি সুদহারের কারণে উৎপাদন খরচ আরেক দফা বাড়বে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই সব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না। আবার পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তাও বলা যাচ্ছে না। যা অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত।
দেশের বৃহৎ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের চেয়ারম্যান আলী হোসাইন আকবর আলী বলেন, বর্তমানে রড বিক্রির অবস্থা খুবই করুণ। রড তৈরি কারখানা মালিকদের কারোরই অবস্থা ভালো নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হবে না; ততদিন এ অবস্থা চলতেই থাকবে।
জানা যায়, বছরের প্রথম কোয়ার্টারকে নির্মাণশিল্পের ভরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এ সময়ে পুরো বছরের রড ও সিমেন্টের মোট চাহিদার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ বিক্রি হয়। মৌসুমকে মাথায় রেখেই উৎপাদন ও বিপণন পরিকল্পনা তৈরি করে রড-সিমেন্ট তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু এবার নির্মাণ মৌসুম শুরু হওয়ার আগে চাহিদা পতনের কারণে শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কমেছে উৎপাদনও।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দুই মাসে কোম্পানি ভেদে ইস্পাতের বিক্রি কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। পাশাপাশি সিমেন্টের বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এর প্রধান কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করছেন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ থাকাকে। কারণ, দেশের মোট ১ লাখ ২০ হাজার টন উৎপাদিত ইস্পাতের প্রায় ৬৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় সরকারি প্রকল্পে। সামপ্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় সিমেন্টের চাহিদা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। সিমেন্ট খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদা কম থাকায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দাম আরও নি¤œমুখী হতে পারে। সিমেন্ট ও ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সরকারের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন শিল্পেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। অপরদিকে আবাসনখাতে দীর্ঘদিন অপ্রর্দশীত আয় বিনিয়োগের সুযোগ ছিল তখনও খুব একটা বাড়েনি বিনিয়োগ। অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেই বিনিয়োগও বন্ধ করে দিয়েছে। এতে আবাসন খাত আরও সঙ্কটে পড়েছে। এছাড়া নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর কারণে এক বছরের ব্যবধানে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। নতুন ‘ড্যাপ’ বৈষম্যমূলক ও অস্পস্ট হওয়ায় এর কারণে নতুন করে ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে না। মানুষ প্লট কিনছে না। ড্যাপ পুনঃবিবেচনা করা না হলে দাম আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা আবাসন খাত সংশ্লিষ্টদের। যার প্রভাবও পড়েছে রড-সিমেন্টখাতে।
অথচ বিগত বছরগুলোতে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এ তিন মাস রড ও সিমেন্টের দাম থাকে ঊর্ধ্বমুখী। গত বছর এ সময়ে রড বিক্রি হয়েছে টনপ্রতি ১ লাখ ৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৭ হাজারের মধ্যে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। চলতি বছর রড বিক্রি হচ্ছে টনপ্রতি ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টাকায়। একই অবস্থা সিমেন্টের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে কোম্পানি ভেদে প্রতি বস্তা ৪৭০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ৪৯০ থেকে ৫৩০ টাকা। উৎপাদনের বিপরীতে চাহিদা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। এরই মধ্যে প্রায় সব রড এবং সিমেন্ট কারখানার উৎপাদন করেছে অর্ধেক। তবে আশার কথা হচ্ছে বছরের শুরুর দিকে এসে কিছু কিছু বিক্রি হচ্ছে। তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ব্যবসায়ীদের দাবি-ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর ক্রমান্বয়ে কমেছে রড ও সিমেন্টের চাহিদা। কারণ হচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের বেশির ভাগই রয়েছেন পলাতক। এ ছাড়া নতুন করে বড় ও মাঝারি কোনো প্রকল্পে হাত দেয়নি সরকার। বেসরকারি পর্যায়ের নির্মাণকাজও রয়েছে একপ্রকার বন্ধ। এতে করে রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা নেমে হয়েছে অর্ধেকে। বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলে রড তৈরির কারখানা রয়েছে ২ শতাধিক। এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিকটন রড উৎপাদন করে। তবে রডের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ৭৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত রডের ৬৭ শতাংশই ব্যবহার হয় সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। বাকি ৩৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বেসরকারি খাতে। এ ছাড়া দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে প্রায় অর্ধশত। এসব প্রতিষ্ঠানের বছরে উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ টন। তবে দেশে প্রতি বছর সিমেন্টের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪ কোটি টন।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, দেশের কোম্পানিগুলোর রড উৎপাদনে সক্ষমতা ১ কোটি ২০ লাখ টন। বছরে সর্বোচ্চ চাহিদা ৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই ব্যবহার হয় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে। বাকি ৪০ শতাংশ বেসরকারি ও ব্যক্তিগত অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহার হয়। বর্তমানে চাহিদা কমে ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। সবচেয়ে বেশি চাহিদা কমেছে সরকারি প্রকল্পে। এখানে রডের চাহিদা ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসায় দামও ধারাবাহিকভাবে কমছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) নির্বাহী পরিচালক মো. শামসুল আলম খান বলেন, আমাদের স্টিল শিল্পের ভৌত অবকাঠামোকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের উপর বড় ধরনের চাহিদা থাকে রড শিল্পে। প্রকল্পগুলোর কাজের মন্থরগতি ও স্থবিরতা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে আগের তুলনায় ব্যবসা- বাণিজ্য অনেকটা কমেছে।