
গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীর সিরামিক রোডে মো. বাবু ওরফে ব্লেড বাবু খুন হন। নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা ব্লেড বাবু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে আরেক চিহ্নিত অপরাধী মুসা সিকদার ওরফে সুমন সিকদারের বিরুদ্ধে। পুলিশও বলছে, ব্লেড বাবু এবং মুসা গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। মুসা সিকদার ওরফে সুমন সিকদার রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন আসামি। এই হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ওমানে পালিয়ে যান। পরে তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনে পুলিশ। তবে গত ৫ আগস্টের পর জামিনে বের হন মুসা।
রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের বিপরীতের রাস্তায় ২১ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে মানি এক্সচেঞ্জার ব্যবসায়ী কাদের শিকদারও তার সঙ্গে থাকা আরেকজনকে কুপিয়ে কোটি টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় গুলশান থানায় প্রধান আসামি ইয়াসিন, অন্তর রহমানসহ আটজনকে ডাকাতির এক লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশে হস্তান্তর করে র্যাব। তবে গ্রেপ্তারের মাত্র ১০ দিনের মাথায় প্রধান আসামি ইয়াসিনসহ দুজন জামিনে বেরিয়ে আসেন। জামিন পাওয়া আসামি ইয়াসিন হত্যাচেষ্টা, অপহরণসহ একাধিক মামলার চিহ্নিত অপরাধী। আরেক আসামির নামে এ ঘটনা ছাড়াও রয়েছে জাল টাকার মামলা। এ তো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। ভয়ংকর অপরাধ করার পর অল্প দিনের ব্যবধানে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের একই কাজে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে বড় হচ্ছে অপরাধের মাত্রা। অস্থির হয়ে পড়ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার এজাহারের দুর্বলতার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। আবার অনেক সময় বাদীপক্ষের আইনজীবীর রহস্যজনক নীরবতায় আসামিরা সুযোগ নিচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে ২৮৯টি মামলায় ৭৫৮ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১১৫ জনই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছেন অল্প দিনের মধ্যে। যেমন ১৬ জানুয়ারি সূত্রাপুর থানার দস্যুতার এক মামলায় ফাইম খান নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি পরদিনই জামিন পেয়ে যান।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, জামিন পাওয়ার অধিকার সবার রয়েছে। তবে গ্রেপ্তার অপরাধীদের স্ট্যাটাসের বিষয়টি সরকারি কৌঁসুলিকে অবহিত করা উচিত। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা কথা বলে করণীয় ঠিক করা উচিত। তিনি আরও বলেন, শীর্ষ অপরাধী থেকে শুরু করে যারা নানান ধরনের অপরাধ করছে তাদের অপারেশন ডেভিল হান্টের আওতায় আনা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ যাতে স্বস্তি নিয়ে নিরাপদে কর্মস্থলে যেতে পারেন এবং তার প্রিয়জনের কাছে ফিরতে পারেন সেই নিশ্চয়তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিতে হবে। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান। তিনি বলেন, কয়েক শ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু তারা আবার আদালত থেকে জামিন নিয়ে একই ছিনতাই কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। আদালতে ছিনতাইকারীদের কার্যকলাপ ও এর ভয়াবহতা, জনজীবনে কী পরিমাণ অশান্তি তৈরি করছে তা তুলে ধরেন, যাতে আদালত জামিন দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সরকার পক্ষের আইনজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও অনুরোধ জানান তিনি।
একাধিক সূত্র এবং অনুসন্ধান বলছে, গত ডিসেম্বরে ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, লালবাগ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল হক ইমনের সহযোগীরা লালবাগ এলাকার ২৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আমিনুল ইসলাম আমিনকে হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। ভাইরাল হওয়া ভিডিওর কথোপকথন এবং স্থানীয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে ইমনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আলমগীর, হেজাজ ওরফে আবজাল, জসিম আমিনের গলায় চাপাতি ধরেছিল। পাশে থাকা অপর দুইজনের হাতেও চাপাতি এবং আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তারা আমিনের কাছ থেকে ডিশ এবং ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল। এর বাইরে আজিমপুর এলাকায় নানা অপরাধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কামরুজ্জামান সুজন, রফিকুল ইসলাম রানার বিরুদ্ধে।
মিরপুর-১০ নম্বর গোলচক্করে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী হাবিবুর রহমান ওরফে তাজের হয়ে স্থানীয় মামুন নামের এক ব্যক্তি নিয়মিত চাঁদাবাজিসহ একের পর এক অপরাধ করে আসছে। তাজের নির্দেশে মামুন ওই ১০ নম্বর গোলচক্কর, ১৩ নম্বরসহ আশপাশের এলাকা হাসনাত, নজু, সিজু, মনির, জুয়েল এবং জিন্নাহকে ভাগ করে দিয়েছে। নিজেরা একটি অংশ রেখে বড় অংশটি পাঠিয়ে দিচ্ছে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী তাজের কাছে। বিভিন্ন সময়ই ভুুক্তভোগীদের ফোনে ধরিয়ে দেয় মামুন। অপর প্রান্ত থেকে ঠান্ডা মাথায় নিজের বক্তব্য শুনিয়ে দেন তাজ।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মিরপুর-কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী তাজের বিরুদ্ধে মিরপুর, কাফরুল, পল্লবীসহ বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে নয়টি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় তার সাজাও হয়েছিল। তবে ৫ আগস্টের পর তিনি জামিনে বের হয়ে মালয়েশিয়া পালিয়েছেন।
মিরপুর-৭, ১১, ১২ নম্বর এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত হোসেন। সঙ্গে নিয়েছেন যুবলীগ নেতা মুক্তারের সহযোগীদের। তবে বর্তমান সময়ে নূর সালাম নামের এক রাজনৈতিক নেতা তাদের শেল্টার দিয়ে আসছেন। মুক্তারের সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম হলো আমিন, জুয়েল, কাওসার। মুক্তারের সহযোগীদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বন্দি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে শাহাদত রহস্যজনক কারণে কিছুটা চুপ থাকলেও বর্তমানে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পর জামিন পেয়ে তারা এলাকায় ঝুট, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। জানা গেছে, গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পুলিশ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে না পারার সুযোগটি নিচ্ছে অপরাধীরা। সক্রিয় হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং ও সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাজে লাগাচ্ছে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মসতাসীম তানজীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলার এজাহার এবং চার্জশিটে অনেক দুর্বলতার কারনে অভিযুক্তদের আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হয়। এর বাইরে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে তদন্তকাজে দেরি হলে আসামিদের জামিন পাওয়া সহজ হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া দরকার পুলিশের। মামলার সাক্ষীদের হাজির করে দ্রুত বিচারকাজ শেষ করা উচিত। তাহলে জামিন পাওয়া কঠিন হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ছিনতাই প্রতিরোধ টাস্কফোর্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ৮৪১ জন। জামিন পেয়েছে ১ হাজার ৭৮৬ জন। এ সময় ২৭৭টি ছিনতাই মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে ১১২টি মামলা হয়েছে। এসব ছিনতাইকারীর মধ্যে বেশির ভাগই জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপরাধে জড়িয়েছে। এমনকি জামিনের তিন দিন পরই ছিনতাই করতে গিয়ে গ্রেপ্তারের নজিরও রয়েছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কাজ অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। র্যাবের প্রতিটি সদস্য এ ক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে জামিন দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তের মালিক আদালত।’