
তিন বছরের পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের কাজ ছয় বছরেও শেষ হয়নি। ফের দেড় বছর সময় চাওয়া হয়েছে। নতুন করে আরো ৯১১ কোটি টাকা আবদার করা হয়েছে। যার ফলে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ না হওয়ায় দুই দফায় প্রকল্পটিতে এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।
প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে পাঁচ হাজার ৪২৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলেন, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ছিল একটি জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এটিকে গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর চেষ্টা হয়েছিল। এটি কখনোই গভীর সমুদ্রবন্দর হতো না।গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য চ্যানেল তৈরি সেখানে প্রচুর ব্যয়বহুল হতো।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, ৬৫০ মিটার দীর্ঘ টারমিনাল ও তিন লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটার ব্যাকআপ ইয়ার্ড নির্মাণ ছাড়াও ৬.৩৫ কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক, পাঁচ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৯ সালে। ছয় বছরেও শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একনেকে প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে তিন বছরের কাজ আট বছরে শেষ হবে। একই সঙ্গে ব্যয় বাড়বে প্রায় ৩৭ শতাংশ।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রকল্পটির আওতায় জেটি নির্মাণে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, বর্তমানে ঠিকাদার আরো প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা বেশি চাইছেন। এ সময় টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এ অঙ্গে ব্যয় বাড়বে ১৬১ কোটি টাকা। সব মিলে জেটি নির্মাণে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে ৩০৬ কোটি টাকা। করোনা মহামারির মধ্যে লকডাউনে সই করা চুক্তির আওতায় কাজ না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সব মিলে ৮৫৭ কোটি টাকা বেশি চাইছে।
একই সঙ্গে মুদ্রার বিনিময়হারের পরিবর্তনজনিত কারণে বাড়তি লাগছে ৪৬৪ কোটি টাকা। বেশি সময় ধরে কাজ করায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাড়তি চাইছে ৩০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ইয়ার্ড নির্মাণে প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট বাবদ বাড়তি ১৬০ কোটি টাকা পাচ্ছেন ঠিকাদার। এ খাতে বিনিময় হারজনিত বাড়তি ব্যয় ৩৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সব মিলে ইয়ার্ড নির্মাণে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ১৯৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। একই কারণে আন্ধারমানিক সেতু নির্মাণে ৮৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা বাড়তি পাবেন ঠিকাদার। আর মুদ্রার অবমূল্যানজনিত ১২০ কোটি টাকাসহ সেতুটি নির্মাণে বাড়তি ব্যয় হবে ২০৪ কোটি টাকা।
প্রকল্পটিতে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট কেনার কাজ নির্ধারিত সময়ে শুরু করতে না পারায় বাড়তি দাম বাবদ গুনতে হবে ৪৬৮ কোটি টাকা। এ খাতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয়সহ মোট গচ্চা যাচ্ছে ৫২০ কোটি টাকা।
ফের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মো. নাসির উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) মো. গোলাম রাব্বি কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পটিতে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে কিছু ব্যয় বাড়ছে। এ ছাড়া কয়েকটি খাতে কাজের পরিবর্তনে ব্যয় বাড়ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, করোনা মহামারি যখন ভয়াবহ সেই কঠিন মুহূর্তে এই প্রকল্পে জেটি ও ইয়ার্ড নির্মাণে সিআরসিসি হারবার ও সিএসআইসি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। আবার প্রকল্পে করোনোর কারণে কাজ দেরি হয়েছে বলা হয়েছে। কাজও নির্দিষ্ট সময়ে হয়নি। প্রকল্পের ধীরগতি তাদের কারণেই হয়েছে অথচ সরকারকেই এখন গচ্চা দিতে হচ্ছে। কাজের চুক্তিতে ফাঁকফোকর রাখায় ঠিকাদাররা আগের সরকারের সময়েও বেশি ব্যয়ে চুক্তি করে লাভবান হয়েছেন। এখনো বেশি ব্যয়ের আবদার পেয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক সরকার এসব চুক্তিতে ফাঁকফোকর রেখে গেছে। যার ফলে ট্রেন্ডার হওয়ার পরও আবার ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। এসব ফাঁকফোকর রেখে তারা অবৈধ সুবিধা নিয়েছে। আবার কাজে সঠিকভাবে মনিটরিং করেনি। যার ফলে এখন সময় ও কাজের ব্যয় বাড়ছে। নতুন সরকারও শর্তের কারণে ব্যয় বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। কাজে দেরি হওয়ায় দেখা যাচ্ছে, যে রিটার্ন আসা দরকার ছিল সেটা আসছে না। তাই জনগণের টাকা নষ্ট করে এসব কাজে যাঁরা অনিয়ম করে চুক্তি করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্তা নেওয়া উচিত।
প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাবনায় বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে পায়রা সমুদ্রবন্দর। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নির্মাণসামগ্রী ও অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাসপূর্বক দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় স্থানে পরিবহন সহজতর করার জন্য অর্থাৎ পায়রা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর জন্য কনটেইনার টার্মিনাল, মাল্টিপারপাস টার্মিনালসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে মূল প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে মোট তিন হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্পের বিভিন্ন কম্পন্যান্ট যেমন জেটি, কনটেইনার টার্মিনাল, সার্ভেইল্যান্সসহ ছয় লেন বিশিষ্ট রোড এবং আন্ধারমানিক নদীর ওপর নির্মিতব্য সেতুর ডিজাইন, ড্রয়িং চূড়ান্ত হওয়ায় রায় পরিবর্তনজনিত কারণে মোট চার হাজার ৫১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রথম সংশোধন অনুমোদিত হয়। পরে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক ২০২৩ সালের ১২ জুলাই প্রকল্পটির মেয়াদ ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে দুই বছর অর্থাৎ জুন ২০২৫ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
প্রকল্প প্রস্তাবনা সূত্রে জানা গেছে, জুন ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে তিন হাজার ২৯ কোটি টাকা। বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৭২ শতাংশ।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য অ্যাকসেসসহ জেটি, ব্যাকআপ ইয়ার্ড, সংযোগ সড়ক, আন্ধারমানিক নদীর ওপর সেতু নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এতে বন্দরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জাহাজ নোঙরসহ কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং কনটেইনার ধার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে বন্দরের উপযোগিতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে।