Image description

শুরু হয়েছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান। যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ ফরজ এই ইবাদত পালন করছেন। ইসলামবিদ্বেষী, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে বিগত ১৫ বছর দেশে ইসলামি সংস্কৃতিকে এক ধরনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখা হয়। ৫ আগস্ট পরবর্তী হাসিনামুক্ত দেশে স্বস্তির সঙ্গে রোজা আদায় করছেন মুসলমানরা।

রহমত-মাগফিরাত ও নাজাতের এই মাসের প্রথম দিনেই তাই রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র ফুটে উঠেছে বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির ছোঁয়া। বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট আর বাজার সবখানের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। সর্বত্রই রয়েছে ধর্মীয় এক আমেজ।

নতুন সূচিতে অফিস, ইফতারের বিশেষ বাজার, মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের ভিড় আর ইফতার আয়োজন এই আমেজকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। রমজানকে স্বাগত জানিয়ে আলোকসজ্জা করতেও দেখা গেছে বুয়েটের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় গণইফতারের আয়োজন করা হয়।

গত শনিবার রমজানের চাঁদ দেখার পর থেকেই মূলত দেশের সর্বত্র ধর্মীয় আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। কর্মজীবী মানুষ প্রয়োজনীয় বাজার নিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরে যান। এশার নামাজের পর তারাবির নামাজ জামাতে পড়েন ধর্মপ্রাণ মানুষ। অনেকে অফিস বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেই বিশেষ জামাতের ব্যবস্থা করেন। শেষ রাতে সাহরি খেয়ে রোজা রাখা শুরু করেন তারা। প্রথম সাহরিতেই মসজিদে মসজিদে রোজাদারদের ডাকার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় সবার। এ সময় অনেকে মসজিদের মাইকে কোরআন তেলাওয়াত ও ইসলামি সংগীত পরিবেশন করেন। শহরের মহল্লায় মহল্লায় সাহরি পার্টির ডাকাডাকিতেও রোজার ভিন্ন আমেজ ফুটে ওঠে।

রোববার প্রথম রোজার সকাল থেকেই সর্বত্র ধর্মীয় আমেজ দেখা যায়। অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁ দিনে বন্ধ ছিল। কিছু হোটেল বা চায়ের দোকানে পর্দা টানিয়ে বেচাকেনা করতে দেখা যায়। দুপুরের পর আবার সবখানে আরেক চিত্র দেখা দেয়। স্থায়ী হোটেল-রেস্তোরাঁসহ ফুটপাথ ও পাড়া-মহল্লায় অনেক অস্থায়ী ইফতারের দোকান বসানো হয়।

রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী চকবাজার ও বেইলি রোডসহ অভিজাত এলাকার ইফতার বাজারগুলো ছিল জমজমাট। দুপুরের পর থেকেই ইফতারের দোকানে বিক্রি শুরু হয়। বিকেলে এসব দোকানে ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। ফলের দোকানগুলোতে প্রাধান্য পাচ্ছে নানা জাতের খেজুর। কাঁচাবাজারগুলোতেও ইফতারে ব্যবহার্য জিনিস যেমন শসা, লেবু ইত্যাদি বেশি বিক্রি হতে দেখা যায়।

রোজা উপলক্ষে রোববার থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত এবং ব্যাংক-বীমায় নতুন সময়সূচি চালু হয়েছে। সর্বত্রই কর্মজীবী মানুষের অনেককে এবার স্বস্তিতে পাঞ্জাবি-টুপি পরতে দেখা যায়। অনেকের হাতে ছিল তসবিহ। মসজিদের পাশাপাশি অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও নামাজের জামাতের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে।

অফিস শেষ হতেই কর্মজীবীরা ছুটে যান বাসায় পরিবার-স্বজনদের সঙ্গে ইফতার করতে। অনেকে আবার অফিসে বা অন্য স্থানে ইফতারের আয়োজন করেন। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ অধিকাংশ মসজিদেই বিশেষ ইফতারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় গণইফতারের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে আলাদা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে।

এদিকে ৫ বছর পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইফতার আয়োজন করা হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন দুই হাজার মুসল্লির ইফতারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির মসজিদ ও মার্কেট বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, এবারের ইফতারির মেন্যুতে খেজুর, ছোলা-মুড়ি, জিলাপি, পেঁয়াজু, বেগুনি ও এক বোতল পানি থাকছে। মহিলা নামাজ রুমেও ইফতারের ব্যবস্থা থাকছে।

দীর্ঘদিন বন্ধের পর এবার ইফতার আয়োজন প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আ. ছালাম খান আমার দেশকে বলেন, করোনা সমস্যা ও বাজেট সংকটসহ নানা অজুহাতে এতদিন বন্ধ করে রেখেছিল ইফতার আয়োজন। এবার প্রায় ৩০ লাখ টাকা বাজেট করে এই ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে। টেন্ডারের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান এই ইফতার সরবরাহ করছে।

জানা গেছে, বায়তুল মোকাররমে বেশ কয়েক বছর ধরে মুসল্লি কমিটির ব্যানারে একটি বড় শিল্প গ্রুপ ইফতার দিত। এবার তাদের বাদ দিয়ে গঠিত নতুন কমিটি বায়তুল মোকাররমের ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় প্রতিদিন ২ হাজার ব্যক্তির ইফতারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমেদ জানান, মসজিদের আলাদা স্থানে প্যাকেট করে ইফতার বিতরণ করা হচ্ছে। কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. হাসান মানিক ও কোষাধ্যক্ষ জালাল সরকার জানান, আগে ইফতারে অনেকে আসতে আগ্রহী হতেন না। এবার স্বাচ্ছন্দ্যে ইফতার আয়োজনে সহযোগিতা করছেন। এছাড়া মুসল্লি সমাজের ব্যানারে ফজলুল হক নামের এক ব্যবসায়ীর উদ্যোগেও বায়তুল মোকাররমে আলাদা ইফতার আয়োজন করা হচ্ছে।

শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ের অধিকাংশ মসজিদে ইফতারের বিশেষ আয়োজন থাকছে। বাসা-বাড়িতেও অনেকে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ইফতার করেন। অনেকে আবার প্রতিবেশীর মধ্যে ইফতার বিতরণ করেন।

প্রথম রোজায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসিতে গণইফতারের আয়োজন করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নবগঠিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। সহস্রাধিক রোজাদারের জন্য এই গণইফতার কর্মসূচিটি টিএসসির খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

রোজা উপলক্ষে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি শুরু হয়েছে। তাই রাস্তাঘাটে শিক্ষার্থীদের তেমন চলাফেরা ছিল না। তবে ঢাকায় অফিস শুরু ও শেষ সময়ে যানবাহনে যাত্রীদের ব্যাপক চাপ দেখা যায়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় যানজট। তবে ইফতারের আগমুহূর্তে চিত্র পুরো পাল্টে যায়। ইফতারের সময় রাস্তাঘাট অনেকটা জনশূন্য হয়ে পড়ে। অবশ্য যারা সময়মত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি তারা রাস্তায় বা পথিমধ্যে পানি বা সামান্য কিছু দিয়ে ইফতার সেরে নেন। সর্বত্রই দেখা যায় রোজাদারদের ইফতারের ভিন্ন এক চিত্র।

প্রথম রোজায় বায়তুল মোকাররমসহ বিভিন্ন মসজিদ এলাকায় দেখা গেছে, সেখানে ফুটপাথের দোকানগুলো আতর, টুপি, তসবিহ্সহ ধর্মীয় জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। রোজা উপলক্ষে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ পাশে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী ইসলামি বইমেলা। সেখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন বই ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশনে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট ৬৫টি স্টল স্থান পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এদিকে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা ও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানিয়ে আগেই মিছিল-সমাবেশ ও বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। রমজানকে স্বাগত জানিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় শাহবাগে সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছিল আলোচিত বিষয়।