Image description

উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় শরিফুল ইসলাম ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন। নেন প্রশিক্ষণ। করোনায় যখন অলস সময় কাটছিল, তখন অনলাইনে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ডিজিটাল মার্কেটিং ও ওয়েব ডিজাইনের কাজ শুরু করেন। প্রথম মাসেই আয় হয় ১০ হাজার টাকা। সেই থেকে শুরু। ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেন। ছয় মাস পর থেকে রোজগারও মাসে গড়ে ১ লাখ টাকা। পিতা কর্ম-অক্ষম ব্যক্তি। নিজের পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরেন শরিফুল। ছোট দুই ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচও তাকে বহন কষ্ট হতো না।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ুয়া শরিফুলের সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ১৩ দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সব কিছু তছনছ হয়ে যায়। বিদেশি ১০ বায়ারের কাজ তখন চলমান ছিল। কিন্তু বায়ারের পাঠানো বার্তার উত্তর দিতে পারেননি। কাজ শেষ করে বায়ারের কাছে নির্ধারিত সময়ে তা পাঠাতেও পারেননি। ফলে আস্থা হারিয়ে তার মার্কেটপ্লেস ফাইভারের ছয় জন বায়ার তার অ্যাকাউন্টে নেগেটিভ রিভিউ দেন। দিয়ে দেয় ব্যাড রেটিংও। এরপর থেকে গত সাত মাস যাবত্ একটি কাজও পাননি শরিফুল। আগের জমানো টাকাও শেষ হয়ে গেছে।  তার এবং ছোট ভাই-বোনের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়েছে পুরো পরিবার।

ইত্তেফাকের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমি চারদিকে অন্ধকার দেখি’। শরিফুল ইসলামের মতো দেশের প্রায় ৩ লাখ ফ্রিল্যান্সার গত সাত মাস ধরে বিদেশি বায়ারের কাজ পাচ্ছেন না। এতে পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েছেন তারা। অথচ এই ক্যারিয়ার তৈরি করতে বছরের পর বছর পরিশ্রম করে যেতে হয়েছে তাদের।

নাইমুল ইসলাম রুবেল নামের একজন ফ্রিল্যান্সার বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমার আপওয়ার্ক অ্যাকাউন্ট বাতিল হয়ে গেছে। যতগুলো চলমান কাজ ছিল, সব হারিয়েছি। ক্লায়েন্ট আমাকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আমার সঙ্গে আর কখনো কাজ করবে না। শুধু আপওয়ার্কই নয়, ফাইভারেও গিগ, রেসপন্স রেট ডাউন হয়ে গেছে। গত সাত মাসে একটি কাজও পাইনি। ক্লায়েন্টদের প্রধান শর্ত থাকে তাত্ক্ষণিক যোগাযোগ রাখা, যা আমি ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে ১৩ দিন করতে পারিনি।’ দীর্ঘ সময় ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারায় এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন ফ্রিল্যান্সাররা। ভবিষ্যতেও ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় দেখলে কাজ না দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।  ফিরোজ হোসেন নামের একজন ফ্রিল্যান্সার বলেন, ‘দুইটা চলমান প্রজেক্ট বাতিল হয়েছে। তিনটা প্রজেক্ট একসেপ্ট করতে পারিনি। একটা ব্যাড রেটিং দিয়েছে। এই রেটিংয়ের কারণে কাজ পাইনি এখনো। ভবিষ্যতে আর কাজ পাব বলে মনে হচ্ছে না।’ ফ্রিল্যান্সার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একসঙ্গে অনেক কাজ করছিলাম, সেগুলো শেষ পর্যায়ে থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিতে পারিনি। ফলে আমার মার্কেটপ্লেসের অ্যাকাউন্ট বাতিল হয়ে গেছে। এ ক্ষতির পরিমাণ বুঝিয়ে বলা যাবে না।’

এদিকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়ে জরুরি কাজ করতে অনেক ফ্রিল্যান্সার পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভারত, দুবাই, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কয়েকটি আইটি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের নেপাল পাঠিয়েছিল। তারা বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তবে এই সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি নয়।

বর্তমান  সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ ও ১৬ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ থেকে ২৩ জুলাই ও ৫ আগস্ট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ ও চালুর বিষয়টি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই তখনকার প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের মৌখিক নির্দেশে বাস্তবায়ন করা হয়। ঐ সময় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে ডাটা সেন্টারে আগুন লাগাকে কারণ হিসেবে দেখান প্রতিমন্ত্রী পলক। পরে জানা যায়, ঐ ডাটা সেন্টারে আগুন লাগার সঙ্গে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো সম্পর্কই ছিল না।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের বাংলা ‘মুক্ত পেশাজীবী’। এ পেশায় নয়টা-পাঁচটা চাকরির বাধ্যবাধকতা নেই। অফিস, বাসা বা যে কোনো স্থানে বসেই কাজ করতে পারেন ফিল্যান্সাররা। এজন্য লাগবে নিজের দক্ষতা, বিদ্যুত্ আর গতিশীল ইন্টারনেট-সংযোগ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মীর মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কিছু কাজ করালে তাতে খরচ বেশি হয়। আবার অনেক সময় চাহিদামতো কর্মীও পাওয়া যায় না। তারা তখন বাইরে থেকে (আউটসোর্সিং) নির্দিষ্ট কাজটি করিয়ে নেন। এতে ঐ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির যেমন অর্থ সাশ্রয় হয়, তেমনি যে কোনো স্থান থেকে কাজটি করে ঐ ব্যক্তিও আয় করেন।  দেশে কত ফ্রিল্যান্সার আছেন, তার সঠিক কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টি মার্কেটপ্লেসে কাজ করা হয়। সেগুলো হিসাব করলে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।