
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস এবং দুই হাজারের বেশি শিক্ষক; কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের প্রোফাইলে নেই কোনো গবেষণা প্রকাশনা। এ তালিকায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ও। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র দেখা গেছে।
ওয়েবসাইটে উল্লিখিত শিক্ষকদের প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ২ হাজার ৪৪ জন। এর মধ্যে পাবলিকেশন আছে ১ হাজার ৩৩৯ জনের। অর্থাৎ পাবলিকেশন উল্লেখ নেই এমন শিক্ষকের সংখ্যা ৭০৫, যা মোট সংখ্যার ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ১৩ অনুষদে বিভাগ রয়েছে ৮৩টি। এর মধ্যে কলা অনুষদে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৩৩৬, পাবলিকেশন নেই ১১২ জনের। বিজ্ঞান অনুষদের ১৯৩ শিক্ষকের মধ্যে পাবলিকেশন ৫৬ জনের। বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ২৫৪ শিক্ষকের মধ্যে পাবলিকেশন নেই ১০২ জনের। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষক আছেন ২৮৭ জন। পাবলিকেশন নেই ১১৬ জনের। জীববিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষক সংখ্যা ২৩৮, পাবলিকেশন নেই ৫৫ জনের।
বিভাগগুলোর মধ্যে অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের ১১ শিক্ষকের প্রোফাইলে কোনো পাবলিকেশন পাওয়া যায়নি। তবে সমুদ্রবিজ্ঞান, রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্থাপত্য বিভাগে যথাক্রমে ১২, ১০ ও ৭ শিক্ষক রয়েছেন, তাদের সবার প্রোফাইলে পাবলিকেশন রয়েছে।
১৩ ইনস্টিটিউটে শিক্ষক সংখ্যা ৩৩৫। তাদের মধ্যে পাবলিকেশন নেই ১৪৬ জনের। এর মধ্যে কনফুসিয়াস ও শক্তি ইনস্টিটিউটে শিক্ষক সংখ্যা যথাক্রমে ১১ ও ৪। তাদের কারও প্রোফাইলেই পাবলিকেশন নেই।
এ ছাড়া, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২৭, স্ট্যাটিসটিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ৬, আইবিএর ৩০, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ১৪, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ৮, আইএমএলের ২২, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ৫, ইনফরমেশন টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের ১১, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারাবেলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের ২, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের ৫, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষকের প্রোফাইলে পাবলিকেলশন নেই।
পাবলিকেশন নেই এ তালিকায় আছেন বর্তমান উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া, সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম, লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। আছে বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানের নামও।
পাবলিকেশন আপলোড না থাকার বিষয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘দেওয়া (আপলোড) হয়নি। আমার ৬০টির মতো পাবলিকেশন আছে। পঞ্চাশের মতো কনফারেন্স প্রসিডিং (প্রক্রিয়াধীন) আছে।’ বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের একটি বড় অংশের পাবলিকেশন নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের অতিরিক্ত পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ওয়েবসাইটে প্রোফাইল আপডেটের জন্য বিগত প্রশাসনের সময়ে শিক্ষকদের চারবার চিঠি দেওয়া হয়। এর দায়িত্ব শিক্ষকদের নিজেরই। এজন্য প্রতিটি বিভাগে একজন লোকাল অ্যাডমিনও রয়েছেন। অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শারমিন আক্তার বিভাগের লোকাল অ্যাডমিনের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের কাজ, নতুন কোনো শিক্ষক যোগ দিলে তাকে ওয়েবসাইটে যুক্ত করা। তাদের মেইল অ্যাড্রেস আপডেট করা। শুধু প্রোফাইলিংয়ের কাজ করে দেওয়া হয়। এরপর যার মেইল, তার কাছে চলে যায়। তারা পরে নিজেদের প্রোফাইল আপডেট করেন। শারমিন আক্তারের নিজের প্রোফাইলেও কোনো পাবলিকেশন নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর আগে এ বিষয়ে জানানো হয়েছিল—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এরকম কিছু বলা হয়নি।’
এ বিষয়ে লোকাল অ্যাডমিনরাও তেমন দক্ষ নন। লোকাল অ্যাডমিনের দায়িত্বে ছিলেন সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে এসব জানতাম না। এগুলো কর্মচারীরা করতেন।
আইসিটি সেলের অতিরিক্ত পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, লোকাল অ্যাডমিন নির্বাচন করেন বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান বা পরিচালক। আমরা তাদের শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এবার প্রশ্ন ওঠে প্রশিক্ষণের মান নিয়ে।
গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য গত বছরের নভেম্বরে স্ট্যানফোর্ড ও অ্যালসভিআরস প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় নাম আসে ঢাবির পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক বিল্লাল হোসেনের। তিনি জানান, র্যাঙ্কিংয়ে ভালো করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষকদের প্রোফাইলে তথ্য দৃশ্যমান থাকতে হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক এটি করেন না। এতে ঢাবি আন্তর্জাতিক মানে এখনো যেতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, পাবলিকেশন নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। হয়তো তারা ওয়েবসাইটে আপলোড করেননি। বিভিন্ন সভায় শিক্ষকদের প্রোফাইল আপডেট করতে বলা হয়। এটা তাদের (শিক্ষক) জন্য ভালো, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও ভালো। আমরা আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ, আমাদের তথ্যগুলো ওয়েবসাইটে না থাকা। এ বিষয়ে শিক্ষকদের বলা হবে বলে জানান অধ্যাপক মামুন।