
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরে ২০১৭ সালের শেষদিকে ঠিকাদারি কাজ শুরু করে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই)। এরপর মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তর ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজও পেয়েছে এনডিই। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার মতো কাজ হাতিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এক সদস্যের আত্মীয়তার সুযোগ নিয়ে ঠিকাদারিতে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন এনডিইর মালিক রায়হান মুস্তাফিজ। এরপর নামে-বেনামে ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন ঠিকাদারিতে। অভিজ্ঞতা ছাড়াই সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) একের পর এক হাতিয়ে নেন মেগা প্রকল্পের কাজ। এনডিইর কাজ নিয়ে ২০২৩ সালে প্রশ্ন তুলেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এর মধ্যে গত আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতন হলেও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে নিজের আধিপত্য ঠিকই ধরে রেখেছেন মুস্তাফিজ, বাগিয়ে নিচ্ছেন একের পর এক কাজ। তবে নিজের প্রতিষ্ঠানের কালিমা ঢাকতে এখন জয়েন্ট ভেঞ্চারে নিচ্ছেন তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন প্রতিষ্ঠানকে।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের আওতায় যশোর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রকল্পে ভূমি উন্নয়নের জন্য গত মাসে আহ্বান করা দরপত্রে অংশগ্রহণ করে এনডিই। প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকায় প্রায় ২শ কোটি টাকার ওই কাজ পেতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এনডিএ; খোকন কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে দরপত্র জমা দেয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি দরপত্র শিডিউল ক্রয় করেনি, যা নিয়মের পরিপন্থি। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে দরপত্র জমা দেওয়া অন্য একটি প্রতিষ্ঠান ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড। এভাবে নানা কৌশলে নতুন সরকারের আমলেও কাজ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এনডিই।
তথ্য বলছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সিঙ্গেল ওয়ার্ক অর্ডারে কাজ করা শীর্ষ পাঁচ কোম্পানির মধ্যে এনডিইর অবস্থান তিনে। ২০২৩ সালে টিআইবি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গণপূর্তের পাওয়া ২৮টি কাজের অর্ধেকই সিঙ্গেল ওয়ার্ক অর্ডারে করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এভাবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়েও বড় বড় কাজ বাগানোর ক্ষেত্রে শীর্ষ নাম এনডিই। সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন প্রায় ২৪৫ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তায় ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্পের আওতায় সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। তথ্য বলছে, কেবল এই দুটি বন্দরই নয়, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন আরও কয়েকটি স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ পেতে যাচ্ছে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান এনডিই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঠিকাদারিতে রায়হান মুস্তাফিজের অস্বাভাবিক উত্থানের পেছনে কাজ করেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতা ও জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ নূর আলম চৌধুরী লিটনের প্রভাব। লিটনের স্ত্রীর বোন,রায়হান মুস্তাফিজের ভাই রেজোয়ান মোস্তাফিজের স্ত্রী। আর এই সম্পর্কের বদৌলতে রেজোয়ান মুস্তাফিজের শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয় শেখ রেহানার ছেলে রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নেপথ্যে তাদের পার্টনার হিসেবে রেখে বাগিয়ে নেন একের পর এক কাজ। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে মাত্র ছয় বছরে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি কাজ করার রেকর্ড গড়েন।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একাধিক প্রকৌশলী কালবেলাকে বলেন, এনডিই ছিল সওজে সর্বেসর্বা। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ডেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যাতে এনডিইকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য করা না হয়। একই সঙ্গে বলেছিলেন, এটা শেখ হাসিনা ও তার সামরিক উপদেষ্টার নির্দেশ। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এনডিইর অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে তখন প্রতিষ্ঠানটিকে সওজে নিষিদ্ধ করা হয়।
জানা যায়, ছয় বছরে এনডিই সড়কের যেসব বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছে, তার অন্যতম ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে ফরিদপুর অংশ, নারায়ণগঞ্জের পূর্বাচল লিঙ্ক রোড, কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক, জিনজিরা-কেরানীগঞ্জ-নবাবগঞ্জ-দোহার-শ্রীনগর রোড, বরঙ্গাইল-টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়ক, গফরগাঁও-বরমী-মাওনা সড়ক প্রকল্প, মাওনা-শ্রীপুর-কাপাসিয়া-মনোহরদী সড়ক প্রকল্প, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একাংশ, পায়রা বন্দরের এমব্যাংকমেন্ট অ্যান্ড আর্থ প্রটেকশন, সওজের গবেষণাগার উন্নয়ন ও ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন, তেজগাঁওয়ে ডিটিসিএ ভবন নির্মাণসহ বিপুল পরিমাণ কাজ।
এ ছাড়া গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে পাওয়া বড় কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্লাস টাওয়ার নির্মাণ, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি ভবন নির্মাণ, রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট কালচারাল ভবন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ অফিস ভবন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি আট তলা ভবন, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল ভবন, উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প, সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ভবন নির্মাণ, সচিবালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ভবন, ন্যাশনাল ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার ভবন নির্মাণ, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ভবন নির্মাণ এবং বাংলা একাডেমি ভবন নির্মাণের কাজ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এনডিইর বেশিরভাগ কাজের মান নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া সময়মতো কাজ শেষ না করে প্রায় প্রতিটি কাজেই সময় বৃদ্ধি করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অনেক কাজে বাড়ানো হয় মূল্যেও। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয় ২০২১ সালে, যার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এই প্রকল্পের এখনো অনেক কাজ বাকি। নথি বলছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কাজ হলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। ১১ তলা ভিত বিশিষ্ট (২টি বেজমেন্টসহ) ৯ তলা লাইব্রেরি ভবন নির্মাণ করা হবে। এর জন্যে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২৪ কোটি টাকা। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট গণপূর্তের একজন প্রকৌশলী জানান, এ প্রকল্পের কাজ ২০২৬ সালের আগে শেষ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন কাজের যে গতি রয়েছে তাতে আরও অন্তত তিন বছর লাগবে। গতি বাড়ালে ২৬ সালের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং গণগ্রন্থাগার নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, ২০২৬ সালের জুনে কাজ শেষ হবে। আমরা দ্রুত কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি অনুরোধ করেছি।
এদিকে, এনডিইর অনিয়ম এবং একচেটিয়া ব্যবসার বিষয়ে দুদকেও অভিযোগ জমা পড়েছে। দুদক থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ-সংক্রান্ত নথিতে বলা হয়েছে, শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠতার দাপটে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ পেতে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি এনডিই। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাজ করে বিল তোলাসহ বেশি কাজ দেখিয়ে বাড়তি বিল আদায়ের মতো অভিযোগ আছে।
এর পাশাপাশি এনডিই রেডিমিক্স কোম্পানির নামে বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানিটি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান থেকে পাথর এবং চীন থেকে রেডিমিক্স সরঞ্জাম আমদানি করে। এসব আমদানিতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমেও বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ করা হয়েছে দুদকের অভিযোগে। এ ছাড়া এনডিই কর্ণধার রায়হান মুস্তাফিজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অর্থের জোগান দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রায়হান মুস্তাফিজ কোম্পানির অনিয়মের বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, ‘২০২২ সালে আমি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে কোম্পানিটি কিনে নিয়েছি। এর আগের অনিয়মের দায়ভার আমার নয়। এখন এনডিই কাজকর্মে অনেক ট্রান্সপারেন্ট। তিনি অনিয়ম স্বীকার করে বলেন, আমার ভাইয়ের মালিকানা থাকাকালে সে রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, তারেক আহমেদ সিদ্দিকী ও লিটন চৌধুরীর প্রভাবে কাজ করেছে।’