
কক্সবাজার প্রকল্পে প্রতি কি.মি. রেলপথ নির্মাণে শেখ হাসিনা সরকার খরচ করেছে ১৭৯ কোটি টাকা। অথচ ভারত, পাকিস্তান, চীন ও ভিয়েতনামে এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয় ১২-১৭ কোটি টাকা। দুর্নীতি আর লুটপাট না হলে এই প্রকল্প ২ হাজার কোটি টাকায় শেষ করা যেত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সেখানে ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে বাকি ১৬ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে হাসিনা সরকার। বড় এই হরিলুটে জড়িত রেলের সাবেক মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান ও ব্যয় বাড়ানোর কারিগর নাজনীন আরা কেয়া।
২০১০ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পটির ব্যয় ১০ গুণ বাড়িয়ে খরচের নামে হরিলুট করা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণের জন্য দাম বাড়ানো হয় ৯৬২ শতাংশ।
মাটির বাঁধ নির্মাণের কাজে ব্যয় বাড়ানো হয় ১ হাজার ৪৬৪ শতাংশ। রেলপথ নির্মাণের ব্যয় বাড়ানো হয় ৪৫০ শতাংশ। সেতু এবং কালভার্ট নির্মাণের ব্যয় বাড়ানো হয় ৯৫০ শতাংশ। এমনকি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ কাজের ব্যয় বাড়ানো হয় ২ হাজার ২০০ শতাংশ পর্যন্ত।
একই সময়ে নেওয়া ভারতে প্রতি কি.মি. রেলপথ নির্মাণে ১৪-১৯ কোটি, পাকিস্তান ১৩-১৬ কোটি, শ্রীলঙ্কা ৯০-১৩০ কোটি টাকা। ভারতে কয়েকটি রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। ২০১৬ সালে ভারতের মন্ত্রিসভায় ৩২ হাজার ৫০০ কোটি রুপি বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
এই টাকায় ৭টি নতুন রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়।
ওই ৭টি নতুন রেলপথের দূরত্ব ২ হাজার ৩৩৯ কিলোমিটার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুনভাবে ৩৫টি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়। এতে প্রতি কি.মি. রেলপথ নির্মাণে গড় খরচ পড়ে ১৫.৯৭ কোটি টাকা।
ওই সময়ে কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ কাজে খরচের প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয় ১৫.১৯ কোটি টাকা। কিন্তু পরে ১০ গুণ বাড়িয়ে করা হয় ১৫৪.৪৮ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে এসে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে সব মিলিয়ে ১৭৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
১৫ কোটি থেকে ১৭৯ কোটি টাকা বা ১ হাজার ৮০০ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার খরচ বাড়ানোর কারিগর ছিলেন ওই সময়ের রেলওয়ের পরিকল্পনাকারী কর্মকর্তা নাজনীন আরা কেয়া, সাবেক মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান।
দুর্নীতির বিষয় অস্বীকার করে নাজনীন আরা কেয়া আমার দেশকে বলেছেন, এই প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমজাদ হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমানকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন আকারে পাঠানো হলে কোনো সাড়া দেননি।
পরিবেশ ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র
দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য চুনতি, ফাসিয়াখালী, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের মধ্য দিয়ে নির্মিত এই রেললাইন প্রকল্প।
রেল ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি সম্পৃক্ততায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। যার ফলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জলবায়ু এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ প্রকল্পের ফলে আকস্মিক বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটায় অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে, যা আগে এই অঞ্চলে কখনো ঘটেনি।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এ প্রকল্পকে ‘এ ক্যাটাগরি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার অর্থ এই উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা আর কখনোই আগের অবস্থায় আনা সম্ভব নয়।
রেলওয়ের প্রকল্পে নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে ৬৭ কি.মি. বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড় কাটা হয়েছে ৯১টি স্থানে। যা প্রায় ১৩ কি.মি পর্যন্ত বিস্তৃত। বনভূমি ও সাফারি পার্কে কাটা গাছের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি।
বিলুপ্তপ্রায় হাতির চলাচলের পথ ধ্বংস করা হয় ১১টি স্থানে। নদী, পাহাড় ও জলাশয় অতিক্রম করা হয়েছে ১৭৭টি স্থানে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এ প্রকল্পের বিপক্ষে মতামত দিলেও তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।