
লন্ডন, ২২ ফেব্রুয়ারীঃ লন্ডনে এক জমকালো আয়োজনে চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ” পৃথিবীর গোলাবের পথে “-এর আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়েছে পূর্ব লন্ডোনের মাইক্রো বিজনেস সেন্টারে। ২২ ফেব্রুয়ারির এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও লেখকগণ। বক্তারা বইটির ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন এবং একে “কবিতার ছন্দে লেখা গদ্য” বলে অভিহিত করেন।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার ড. ফয়সাল তারিক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক নাজিব, মানব টিভির সম্পাদক সাঈদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান, কমিউনিটি একটিভিস্ট মোজাম্মেল হোসেন, চ্যারিটি কর্মকর্তা এডিএম ইউনুস, লেখক ও গবেষক ডা. কামরুল হাসান, কমিউনিটি নেতা শাব্বীর আহমেদ ও সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুল মুনিম জাহেদী বইটির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মূল্যায়ন করেন। বক্তারা বলেন, এটি শুধুমাত্র একজন মানুষের আত্মজীবনী নয়, বরং ইতিহাসের এক দলিল, যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তারা বইটির ভাষাশৈলীর প্রশংসা করে বলেন, এটি কেবল তথ্যসমৃদ্ধ নয়, বরং অত্যন্ত শিল্পসম্মতভাবে রচিত, যা ইতিহাস ও সাহিত্যের এক দুর্লভ সংমিশ্রণ।

“পৃথিবীর গোলাবের পথে” বইটিতে চৌধুরী মুঈনুদ্দিন তার শৈশব থেকে কর্মজীবনের শুরু এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাবলি বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। তার জন্ম ১৯৪৫ সালে কলকাতার খিদিরপুরে, যেখানে তার বাবা ব্রিটিশ প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগে চাকরি করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাদের পরিবার নোয়াখালীর ফেনীতে ফিরে আসে। তিনি শৈশবের স্মৃতিচারণ করে লেখেন, “এই একটি সকাল, এই একটি দিনের সৌন্দর্য মুদ্রিত হয়ে থাকুক আমার হৃদয় ফলকে চিরকাল। ধন্য আমি জন্মেছি এই দেশে।” গ্রামীণ প্রকৃতির অনন্য পরিবেশ ও পারিবারিক ঐতিহ্যের ছায়ায় বেড়ে ওঠা তার জন্য এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিল।
কৈশোরে এসে তার রাজনীতি ও ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। বাবার কাছ থেকেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মুসলিম লীগের উত্থান এবং ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির জটিল ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ পান। তিনি লিখেছেন, “গল্প-উপন্যাসের পাগল ছিলাম আমি। কিন্তু হৃদয় দিয়ে লেখা ভ্রমণ-কাহিনীর আকর্ষণ ছিল আরো তীব্র, আরো দুর্বার। হয়তোবা ভবিষ্যৎ অশ্রান্ত যাযাবর জীবনের প্রথম প্রতিশ্রুতি।” কৈশোর থেকেই লেখালেখির প্রতি তার ঝোঁক তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে তাকে সাংবাদিকতার পথে নিয়ে যায়।

১৯৬০-এর দশকে তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং সেখান থেকেই তিনি দেশের রাজনৈতিক পটভূমি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির বাস্তব অভিজ্ঞতা তার দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও শাণিত করে। তিনি লিখেছেন, “পশ্চিমারা পূর্ব পাকিস্তানকে কখনোই সমান চোখে দেখেনি। শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতা ছিল উপনিবেশবাদী, তারা চেয়েছিল শোষণকে স্থায়ী করতে।” এই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান, ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্র গণজাগরণ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঘটনাবলির সরাসরি সাক্ষী হন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় চৌধুরী মুঈনুদ্দিন সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসায় উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব তখনো বাড়িতেই ছিলেন, যদিও তার সেদিন প্রেসিডেন্ট হাউসে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, “আলোচনা প্রায় ভেঙে গেছে, আমরা তাদের সর্বশেষ প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছি। আজকের বৈঠক শুধু এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার জন্যই।” চৌধুরী মুঈনুদ্দিন জানতে চান, এর পরিণতি কী হতে পারে। শেখ মুজিব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, “এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই, আল্লাহই ভালো জানেন।”
কথোপকথনের এক পর্যায়ে চৌধুরী মুঈনুদ্দিন শেখ মুজিবের গাড়িতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা লাগানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আর বলো না, ছেলেরা জোর করে লাগিয়ে দিয়েছে।” তখন চৌধুরী মুঈনুদ্দিন প্রশ্ন করেন, “ছেলেরা নেতা, না আপনি নেতা? তারা জোর করে লাগিয়ে দিল আর আপনি সেটা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাউসে যাচ্ছেন, ইয়াহিয়া কি তাহলে বিশ্বাস করবে যে আপনি পাকিস্তান ভাঙতে চান না?” শেখ মুজিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর অভিমানের সুরে বলেন, “পশ্চিমারা বাঙালির অধিকার দেবে না। তাই আমি কী করব?”
বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আওয়ামী লীগের শাসনব্যবস্থার দিকটিও বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। লেখক দেখিয়েছেন, কিভাবে ১৯৭২-৭৫ সালের মধ্যে দলটি একদলীয় শাসনের দিকে অগ্রসর হয় এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যত ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করে। তিনি লিখেছেন, “যে দল একসময় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিল, সেই দলই ক্ষমতায় আসার পর ভিন্নমত সহ্য করতে পারছিল না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হতে লাগল।”
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব বাকশাল গঠনের মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন, যেখানে বিরোধী দল নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং মাত্র চারটি সংবাদপত্র চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে চৌধুরী মুঈনুদ্দিন লিখেছেন, “বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কার্যত ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছিল। বিরোধী দল, মুক্ত মতামত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেল।”
আগত দর্শকদের এক প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী মুইন উদ্দিন বলেন, শেখ মুজিব খুব সাহসী ব্যাক্তি ছিলেন না। তার চরিত্রের মধ্যে নানারকম দ্ধৈধতা ছিল। তিনি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাননি। তিনি বলেন, শেখ মুজিব যেদিন গ্রেফতার হন সেদিন তিনি আট ঘন্টা তার সাথে ছিলেন। চৌধুরী মুঈন উদ্দিন বলেন, তার কন্ঠের জ্বালাময়ী বক্তব্য মানুষকে উদ্বেলিত করতো।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বইটির রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও সাহিত্যমান নিয়ে প্রশংসা করেন। তারা বলেন, “এটি কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা নয়, বরং ইতিহাস, সাহিত্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের এক অনন্য সংমিশ্রণ।” এক পাঠক বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “এটি এমন এক গ্রন্থ যা আমাদের জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি তৈরি করে।”
অনুষ্ঠান শেষে বইটির একটি পাঠ পর্যালোচনা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দর্শকরা লেখকের সঙ্গে তাদের মতামত বিনিময় করেন। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ বলে মন্তব্য করেন আলোচকরা। কামাল শিকদারের সঞ্চালনে অনুষ্ঠিত এই প্রকাশনা অনুষ্ঠানের শেষে সবাইকে ধনবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সাকিব মুঈন।