
মেক্সিকোয় বিপ্লবের (১৯১০-১৯২০) পর দেশটিতে ব্যাপক মাত্রায় ভূমি সংস্কার করা হয়। দেশটির ওই বিপ্লব ও পাল্টা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কৃষকদের ভূমি অধিকারের দাবি আদায়।
মেক্সিকোয় বিপ্লবের (১৯১০-১৯২০) পর দেশটিতে ব্যাপক মাত্রায় ভূমি সংস্কার করা হয়। দেশটির ওই বিপ্লব ও পাল্টা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কৃষকদের ভূমি অধিকারের দাবি আদায়। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে এ ভূমির অধিকার নিশ্চিত করেন সেখানকার বিপ্লবীরা।
বলশেকিভ বিপ্লবের পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালেই বড় ধরনের ভূমি সংস্কারে হাত দেয়া হয়। এতে বৃহৎ ভূমি মালিকদের থেকে জমি উদ্ধার করে তা স্থানীয় কৃষক ও কমিউনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এতে কৃষি উৎপাদনে নয়া জাগরণ সৃষ্টি হয়। এ ভূমি বণ্টনকে রাশিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক সংস্কার হিসেবে দেখা হয়। এ সংস্কার রুশ সমাজের ক্ষমতার কেন্দ্রেও ভারসাম্য নিয়ে আসে। সামাজিক এলিটদের সঙ্গে উৎপাদন শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে যুক্ত হন ভূমিহীন কৃষকরা। ইতিহাস অনুযায়ী, রাশিয়া ও মেক্সিকোয় বিপ্লব দানা বাঁধার বড় অংশজুড়ে ছিল কৃষকের ভূমি মালিকানার দাবি, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছাড়িয়ে পড়ে।
একইভাবে চীনেও কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর ১৯৪৯-৫০ সালে ব্যাপকভিত্তিক ভূমি সংস্কার করা হয়। জমিদারদের কাছ থেকে ভূমির মালিকানা বুঝিয়ে দেয়া হয় প্রান্তিক চাষীদের, যা দেশটির গ্রামীণ কৃষি ও অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কমিউনভিত্তিক কৃষির অভিজ্ঞতা দেখার জন্য সে সময় চীনে ভিড় বাড়তে থাকে।
একই সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বড় ধরনের ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়ও। এক্ষেত্রে কৃষিকাজে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখা ভূস্বামীদের কাছ থেকে জমির মালিকানা নিয়ে তা বিতরণ করা হয় প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে কার্যকরভাবেই আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভূমি মালিকানা ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে। একই সঙ্গে গ্রামীণ এলাকাগুলোয় বৈষম্য কমে গড়ে ওঠে সমতাভিত্তিক সামাজিক কাঠামো। বাড়ে কৃষির উৎপাদনশীলতা, যা দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।
একইভাবে ভূমির সংস্কার করা হয়েছিল জাপান, তাইওয়ানসহ আরো বেশকিছু দেশে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় শুরু হয় ভূমি সংস্কার কর্মসূচি ‘নিউ ওয়েভ’। এর মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ভূমি সংস্কার করা হয়। এক সময় ফিলিপাইন ও হন্ডুরাসেও প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভূমির সংস্কার।
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভূমির অধিকার নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট হতে থাকে। গত শতকে ভূমির অধিকার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপ্লব ও ক্ষমতার পালাবদলও হয়েছে। একই সঙ্গে ভূমি সংস্কারের বিষয়টি হয়ে উঠেছে যেকোনো দেশের রূপান্তরের পথে মৌলিক সংস্কারের অংশ।
কিন্তু বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ছয় মাসেরও বেশি সময় ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্যে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সরকার ১১টি কমিশন গঠন করলেও প্রান্তিক কৃষকের ভূমি মালিকানা নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় কোনো সরকারই ভূমির সংস্কারে হাত দেয়নি। কিছু আইন প্রণয়ন হলেও ভূমি মালিকানার কাঠামোয় কোনো কার্যকর পরিবর্তন আনা হয়নি।
দেশের গ্রামীণ কৃষিতে ভূমি বণ্টনে রয়ে গেছে বড় ধরনের বৈষম্য। এখনো দেশের গ্রামীণ কৃষি খাতে নিয়োজিত বেশির ভাগ পরিবারই ভূমিহীন। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইএফপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫৬ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের কোনো জমি নেই। যদিও গ্রামাঞ্চলে মোট কৃষিজমির ৬৬ শতাংশই এখন আয়-ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষ ১৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের দখলে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের ভূমি সংস্কার নিয়ে কাজ শুরু করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরাও। সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক টাস্কফোর্সের প্রধান ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখানে ভূমি নিয়ে বহুকাল কোনো আলাপ নেই, গবেষণাও নেই। এখন ভূমি ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি অন্যায্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের হাতে খুব বেশি জমি নেই। খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় প্রযুক্তি ও উন্নত যন্ত্রায়নের কথা বললেও ভূমির কথা নেই। কত দ্রুত আমাদের ভূমির ব্যবহার বদলে যাচ্ছে, সেটিও বোঝা যাচ্ছে না। এটা জানা দরকার। এখন গবেষকদের মধ্যেও কৃষি নিয়ে আগ্রহ কম। যদিও জিডিপির ২৩ শতাংশে অবদান রাখছে গ্রামীণ অর্থনীতি।’
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশের বেশি নিয়োজিত রয়েছে কৃষি খাতে। কৃষিকাজে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ। তবে কৃষিতে নিয়োজিত যেসব কৃষকের জমি নেই, তারা জমি বর্গা নিয়ে আবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আইএফপিআরআইয়ের গবেষণার তথ্যমতে, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৮ ও ৬৪ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবারের কোনো ভূমি নেই। এছাড়া ঢাকা বিভাগের ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের কোনো ভূমি নেই। রংপুর ও বরিশাল বিভাগের ক্ষেত্রে এ হার ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ করে। রাজশাহী বিভাগের ৫২ দশমিক ১ ও খুলনা বিভাগের ৪৭ শতাংশ পরিবার ভূমিহীন। এসব পরিবারের কৃষির জন্য আলাদা কোনো ভূমি নেই।
গবেষণার বিষয়ে আইএফপিআরআইয়ের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আখতার আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্রামের ভূমিহীন কৃষকদের জমির মালিকদের উৎপাদনের অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের আর তেমন কিছু থাকে না। কিন্তু বিকল্প না থাকায় তারা কৃষিতে যুক্ত থাকে। এখন কীভাবে এসব কৃষককে সহায়তা করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে আমাদের মতো দেশে ভূমি সংস্কার কতটা সম্ভব হবে, সেটি এখনো নিশ্চিত না। যদিও আগে অনেক দেশেই এটা হয়েছে।’
দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথার বিলোপ ও ভূমি মালিকানা সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়। সে সময় পূর্ববঙ্গে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে স্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত করে বর্গাচাষীদের সরাসরি রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু পরে ১৯৬১ সালে আইয়ুব খান সরকার এর পরিমাণ ধার্য করে ৩৭৫ বিঘা বা ১২৫ একর।
স্বাধীনতার পর ভূমি সংস্কারের বিষয়টিও আইন প্রণয়নেই সীমাবদ্ধ ছিল। মালিকানার কাঠামো পরিবর্তনে এসব আইন কখনই কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ ল্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেশন অর্ডার, ১৯৭২ (১৯৭২ সালের ৯৮ নং আদেশ)-এর ৩ ধারা মোতাবেক পরিবার/সংস্থার মালিকানাধীন জমির সিলিং আবারো ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার আইন সংশোধন করে প্রতি পরিবারের জন্য কৃষিজমির মালিকানা সিলিং নির্ধারণ করা হয় ৬০ বিঘা। এর প্রায় তিন দশক পর ভূমি আইন সংস্কার করে ২০২৩ সালে এক অধ্যাদেশ জারি করে শেখ হাসিনা সরকার। ওই অধ্যাদেশেও পরিবারপ্রতি কৃষিজমির মালিকানা সিলিং ৬০ বিঘা রাখা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ভূমি সংস্কার বোর্ডের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির ফলে কৃষকরা ভূমির মালিক হলেন। তারপর ব্যক্তির কৃষিজমির পরিমাণ ১০০ বিঘা হলো। পরে সেটিকে ৬০ বিঘা করা হয়। এখনো তা ৬০ বিঘাই আছে। অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো ধরনের ভূমি সংস্কার হবে কিনা সেটি জানি না। ভূমি মন্ত্রণালয় সেটি বলতে পারবে।’
এসব আইনে মূলত কয়েকটি শব্দের পরিবর্তন ছাড়া আদতে আর কোনো সংস্কারই হয়নি বলে মনে করছেন ভূমি অধিকার আন্দোলনসংশ্লিষ্টরা। এখনো প্রান্তিক চাষীর জমির মালিকানা নিশ্চিতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে ১৯৫০ সালের আইনে ভূমির মালিকানা সিলিং ১০০ বিঘা ছিল। কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এটিকে বাড়িয়ে ৩৭৫ বিঘা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেটি পরিবর্তন করে ১০০ বিঘা করা হয়। কিন্তু সেটি কার্যকর করা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষাও করা হয়নি। কিংবা ভূমি উদ্ধারও করেনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ করে সিলিং ৬০ বিঘা করা হলো। সেটিও কার্যকর করা হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে এটি পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তন বলতে কিছু শব্দের পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর দিক থেকে কোনো ব্যাপক পরিবর্তন আসেনি। ফলে যারা চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত তাদের হাতে জমি থাকছে না।’
আইনজীবীরাও বলছেন, এসব আইন ভূমি সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত নয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভূমি সংস্কার আইনটি সঠিক বিবেচনায় লেখা হয়নি। এখানে কেউ চাইলে কৃষি জমির মালিক ৬০ বিঘা হতে পারবে। আবার শুধু নালা (অনাবাদি) জমির ক্ষেত্রেও ৬০ বিঘার মালিক হতে পারবে। এ দুটি তো এক হতে পারে না। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে আইনের সংস্কার করা প্রয়োজন।’