Image description
 

২০১৮ সালে মধ্যরাতের নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত আলেমকে গ্রেপ্তার ও গুম করেছিলেন শেখ হাসিনার সরকার। গ্রেপ্তার ও গুমের পর ডিবি অফিসে গোয়েন্দাদের পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন দৈনিক কালবেলা পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সন্তোষ শর্মা।

তার সঙ্গে হিন্দিভাষী লোকজনও জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নিতেন। তারা জিজ্ঞাসা করতেন আলেমরা কেন ভারত ও আওয়ামী লীগবিদ্বেষী। হেফাজতে ইসলামকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবেও তারা তখন উল্লেখ করেন। এমন গুরুতর অভিযোগ করেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি হারুন ইজহার চৌধুরী এবং প্রবাসী হাফেজ আতিকুল্লাহ জুলফিকার।

আমার দেশকে এই দুজন ভুক্তভোগী জানান, সন্তোষ শর্মার পাশে গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও অসহায় বোধ করতেন।

মুফতি হারুন ইজহারকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে শেরেবাংলা নগর থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করে ডিবিতে নেওয়া হয়। আল আনসার ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও দুবাই প্রবাসী আতিকুল্লাহ জুলফিকারকে ২০১৯ সালে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি) চার মাস গুম করে রাখে।

সন্তোষ শর্মার বিরুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসসি উইং বা ‘র’-এর এজেন্ট হওয়ার গুরুতর অভিযোগ তুলে মুফতি হারুন ইজহার চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, ‘দৈনিক কালবেলা পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষ শর্মা ডিবি কার্যালয়ে আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন এবং তার সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও থাকতেন।’ তবে সন্তোষ শর্মা এ অভিযোগকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে দাবি করেন।

মুফতি হারুন ইজহার অভিযোগ করেন, ‘২০২১ সালের অক্টোবর মাসে শেরেবাংলা নগর থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তারের পর তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে সন্তোষ শর্মা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। তার সঙ্গে এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি নিজেকে শ্রীলঙ্কান বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় ছিলেন। ওই ব্যক্তির নাম ছিল ড. নিতিশ।’

হারুন ইজহার বলেন, ‘সন্তোষ শর্মা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন- আমরা কেন ভারতবিদ্বেষী, কেন আওয়ামী লীগবিদ্বেষী? তিনি (সন্তোষ শর্মা) মন্তব্য করেছিলেন- হেফাজতে ইসলাম তো জঙ্গি সংগঠন এবং তারা সবাই আফগান সাপোর্টার ।’

হেফাজতের এই নেতা আরো অভিযোগ করেন, “ডিবিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সামনেই সন্তোষ শর্মা হুমকি দিয়ে বলেছিলেন ‘ঠিকমতো কথা না বললে মাসুল দিতে হবে’।”

ডিবির অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে মুফতি হারুন ইজহার আরো বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদকালে প্রথমে আমার চোখ বাঁধা ছিল। পরে চোখ খুলে দেয়। প্রথমে আমি তাকে (সন্তোষ শর্মা) চিনতে পারিনি। কিন্তু কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবি ও ভিডিও দেখে তাকে চিনতে পারি। ডিবি কার্যালয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন সন্তোষ শর্মা এবং ড. নিতিশ।’

হারুন ইজহার বলেন, ‘ডিবির ডিসি আব্দুল মান্নান, এডিসি ইমরান ও এডিসি তৌহিদও জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘ড. নিতিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাওয়ার সময় ডিসি মান্নানের কাছে একটি খাম দিয়ে যান, যেখানে একটি কাগজ ছিল। পরে ডিসি মান্নান ওই কাগজ হাতে নিয়ে আমাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসেন এবং বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’

নিতিশের সঠিক পরিচয় সম্পর্কে আমার দেশ নিশ্চিত হতে পারেনি।

দেশে ফিরেই গুম ও রিমান্ড

মুফতি হারুন ইজহারের মতো একই ধরনের অভিযোগ করেছেন দুবাই প্রবাসী আতিকুল্লাহ জুলফিকার। প্রবাসে থাকা আল আনসার ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আমার দেশকে জানান, ২০১৯ সালে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি) তাকে চার মাস গুম করে রাখে। এরপর তাকে তিনটি মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে পাঁচ বছর কারাগারে রাখা হয়।

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘২০১৯ সালের ১৩ জুন ঢাকার বাসাবো এলাকায় আমার ব্যবসায়ী অংশীদারের বাসায় যাওয়ার সময় সাদা পোশাকের অজ্ঞাত ব্যক্তিরা চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ১৬ বছর বয়সি ভাগনে মো. হুজাইফা তাহমিদকেও তুলে নেয়। পরে ঢাকার সিটিটিসিতে আটকে রেখে চার মাস তিন দিন ধরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।’

গুম হওয়ার পর ফেনীর দাগনভূঞা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন হাফেজ আতিকুল্লাহ জুলফিকারের আরেক ভাগনে হাফেজ মো. মনছুর আলম। এ ছাড়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের ‍উদ্ধারে সহায়তা চেয়ে ২০১৯ সালের ১৬ জুন র‌্যাব-১০-এ একটি আবেদনও করেছিলেন তিনি। পরদিন একই আবেদন করেছিলেন র‌্যাব-৩-এ। এ ছাড়া খিলগাঁও থানায়ও সাধারণ ডায়ারি করেছিলেন তিনি।

গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দীর্ঘ পাঁচ বছর পর তিনি কারামুক্ত হন।

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘গুমকালে আমাকে ব্যাপক মারধর করতেন এডিসি তৌহিদ।’

এ সময় ডিবি অফিসের ভেতর পুলিশের কেউ নন, এমন ব্যক্তিদের আনাগোনা সম্পর্কেও গুরুতর অভিযোগ করেন তিনি।

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘চার মাস গুম রাখার পর তাকে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় পুলিশের পাশাপাশি দুজন হিন্দিভাষী ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা ভারতে তাদের হয়ে চরমপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়ানোর প্রস্তাব দেন। তাদের একজন ছিলেন সিভিল পোশাকধারী।’

এক প্রশ্নের জবাবে আতিকুল্লাহ আরো বলেন, ‘আমার চোখ খোলা রেখেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। এ সময় ডিবির সঙ্গে থাকা এক ব্যক্তি আমাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একাধিক প্রশ্ন করেন। তখন দুই ব্যক্তি হিন্দিতে আমাকে প্রশ্ন করছিলেন এবং তাদের সহায়তা করছিলেন বাংলাভাষী ওই ব্যক্তি।’

তিনি আরো বলেন, ‘তারা আমাকে ভারতে চরমপন্থায় জড়িত হওয়ার প্রস্তাব দেন। এ ছাড়া আল মারকাজুলের শীর্ষ এক ব্যক্তি সম্পর্কেও প্রশ্ন করে মিথ্যা জবানবন্দি আদায়ের চেষ্টা করেন ।’

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমি একটি ছবি দেখে ওই ব্যক্তিকে চিনতে পারি। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের সঙ্গে থাকা সিভিল পোশাকধারী ওই ব্যক্তি বর্তমানে দৈনিক কালবেলার সম্পাদক সন্তোষ শর্মা।’

আতিকুল্লাহ বলেন, ‘আমাকে নির্যাতনের মাধ্যমে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয় এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হয়।’ তবে হিন্দিভাষী ব্যক্তিদের পরিচয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি ভুক্তভোগী এই প্রবাসী।

আমার দেশ-এর পক্ষ থেকেও ওই দুই ব্যক্তি বা ভারতের হয়ে কাজ করার যে অভিযোগ আতিকুল্লাহ তুলেছেন, তা নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

কে এই সন্তোষ শর্মা

পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নির্যাতন চালানোর জন্য সন্তোষ শর্মা পুলিশ কর্মকর্তাদের টাকা দিতেন বলেও অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী।

সন্তোষ শর্মা বর্তমানে দৈনিক কালবেলার সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি এর আগে শক্তি নামক একটি পত্রিকায় কাজ করেছেন। এ ছাড়া সাপ্তাহিক সুগন্ধার মালিক এবং দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন তিনি। সন্তোষ শর্মার শ্বশুর বীরেন শিকদার মাগুরা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।

গত বছরের ৫ আগস্ট তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ২৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদকে চিঠি পাঠায়। একই চিঠি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেও পাঠানো হয়, যেখানে সন্তোষ শর্মার নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতোমধ্যে তার প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে সন্তোষের ‘অসন্তোষ’

অভিযোগের বিষয়ে গত মঙ্গলবার রাতে কালবেলা পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষ শর্মার অফিসে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার কক্ষে তখন পত্রিকার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক বসেছিলেন। এ ছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের ঢাকার একজন নেতাকেও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি।

দীর্ঘ আলাপের পর অভিযোগের বিষয়টি সন্তোষ শর্মা হেসে উড়িয়ে দেন। মুফতি হারুন ইজহারের অভিযোগের বিষয়ে সন্তোষ শর্মা আমার দেশকে বলেন, ‘হারুন ইজহারের সঙ্গে কোনোদিনই আমার কথা হয়নি। তার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’

‘আপনি কখনো ডিবি অফিসে যাননি’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পেশাগত কাজে তো আমি ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছি।’

প্রবাসী হাফেজ আতিকুল্লাহ জুলফিকারের প্রসঙ্গে সন্তোষ শর্মা বলেন, ‘আপনার মুখে এই নাম প্রথম শুনলাম।’

সন্তোষ শর্মার দাবির বিষয়ে গত বুধবার আবারো মুফতি হারুন ইজহারকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘সে মিথ্যাবাদী। ডিসি আব্দুল মান্নান, এডিসি ইমরান ও এডিসি তৌহিদকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সত্যতা পাওয়া যাবে।’

এই বিতর্কের বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।