
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ সেক্টরে বিতর্কিত ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখনো তৎপর। তারা নানা কৌশলে বর্তমান সরকারের মেয়াদেও কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিপু সিন্ডিকেটের এমন এক সদস্যের কোম্পানিকে ৮শ কোটি টাকার কাজ দিচ্ছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে দরপত্রে নন-রেসপন্সিভসহ বেশ কিছু শর্তভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও আরইবি খোদ বিশ্বব্যাংকের শর্তভঙ্গ করেছে। এমনভাবে প্রকল্পটির ডিজাইন করা হয়েছে যাতে গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের প্রায় ৯০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে আছে ৭২টি পাওয়ার ট্রান্সফরমার, এআইএস প্যানেল, ওভিসিবি, সিটি ও পিটি এবং ডিসকানেক্ট প্যানেল অন্যতম। অথচ বাংলাদেশে এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য ১০টির বেশি বড় কারখানা আছে। ৩৩ কেভি জিআইএস-প্যানেল প্লাগইন বসানোর সিস্টেমের প্রয়োজনীয় শর্তটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে একটি বিশেষ কোম্পানি কাজটি পায়। এতে বিশ্বের অনেক নামিদামি কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিতে পারেনি। কিন্তু তারপরও আরইবির সিন্ডিকেটটির (যারা নসরুল হামিদ বিপুর আমলে ব্যাপক প্রভাবশালী ছিলেন) কোম্পানিকে দরপত্রের আর্থিক ও টেকনিক্যাল অংশের দুটিতেই কৌশলে রেসপন্সিভ দেখিয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক ও আরইবি কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির যাচাই-বাছাইয়ে আইডিয়াল ইলেকট্রিক এন্টারপ্রাইজ নামে একটি কোম্পানি দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। বর্তমানে অনুমোদনের জন্য ফাইলটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে আইডিয়ালকে কার্যাদেশ দেওয়া হবে।
এদিকে আইডিয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই কোম্পানিটি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ বিভাগে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। শুধু পিডিবি (পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড) নেসকো আর খুলনার ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে (ওজোপাডিকো) আইডিয়াল এন্টারপ্রাইজ ৩ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে। বর্তমানেও ওজোপাডিকোতে ২শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে কার্যাদেশ পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। অভিযোগ আছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সাবেক প্রভাবশালী পিএস সেলিম আবেদের হাত ধরে কোম্পানিটি লাইমলাইটে আসে।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একতরফাভাবে সব কাজ আইডিয়ালকে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ বিভাগে অসংখ্য অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার সাবেক পিএস সেলিম আবেদের হস্তক্ষেপে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির যুগান্তরকে বলেছেন, গত ১৭ বছর গুটিকয়েক কোম্পানি সিন্ডিকেট করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। অন্য কেউ যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য টেন্ডারে নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হতো। আমরা এই সিন্ডিকেট ভাঙব। প্রতিযোগিতা তৈরি করব। ইতোমধ্যে এই সিন্ডিকেটের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এজন্য টেন্ডার শিডিউলেও বেশ কিছু সংস্কার আনার কাজ চলছে। তিনি বলেন, আইডিয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
এ প্রসঙ্গে আইডিয়াল ইলেকট্রিক্যাল এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তিনি নিয়ম মেনেই আরইবি’র দরপত্রে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা বিপু সিন্ডিকেটের সদস্য নই। উলটো ১৭ বছর ধরে একটি সিন্ডিকেট এই সেক্টর জিম্মি করে রেখেছিল। নতুন সরকারের আমলে এখন তারা আইডিয়ালের সর্বনিম্ন হওয়াকে সহ্য করতে পারছে না। এজন্য বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের পিডির কাছে অভিযোগ করে হেরেছেন। আরইবি’র চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে হেরেছেন। সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) কাছে মামলা করেছেন। সে মামলায় হেরেছেন। মুজিবুর রহমান বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি দরপত্রের আর্থিক ও টেকনিক্যাল দুটি ধাপেই রেসপন্সিভ। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও তার সাবেক পিএস সেলিম আবেদকে তিনি চেনেনও না, কোনোদিন দেখেনওনি। তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করার প্রশ্নই ওঠে না।
মর্ডানাইজেশন অ্যান্ড ক্যাপাসিটি এনহেন্সমেন্ট অব আরইবি নেটওয়ার্ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ নামে এই প্রকল্পের দরপত্রে মোট ৮টি কোম্পানি অংশ নেয়। ৩টি ভিন্ন ভিন্ন বিড ডকুমেন্টে ৩টি প্যাকেজের প্রতিটি ২টি করে ৬টি লটের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৪৫টি ৩৩/১১ কেভি টার্ন-কী সাবস্টেশন ক্রয়ের জন্য এই দরপত্র দেওয়া হয়।
রিভেরি পাওয়ার অ্যান্ড অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিং নামে দরপত্রে অংশ নেওয়া একটি কোম্পানি সিপিটিইউ’র কাছে দেওয়া অভিযোগে বলে, আরইবি’র ওয়েবসাইটে প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের অনুমোদিত এপিপি অনুসারে এই সাবস্টেশন প্রকল্পগুলোর ক্রয় পদ্ধতি ছিল ওটিএম (আইসিটি)। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই এই টেন্ডারের ক্রয় পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়। বিশেষ কোনো কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য আরইবি এই কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস অনুযায়ী বিডিংয়ে প্রতিযোগিতা সীমিত করতে পারে এমন কোনো শর্ত আরোপ করা যাবে না। বাংলাদেশে আইডিয়ালের সাবস্টেশন তৈরির কোনো ফ্যাক্টরি নেই। মূলত ভারতসহ কয়েকটি দেশের কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চার করে তাদের পণ্য বিক্রির কাজ করছে আইডিয়াল এন্টারপ্রাইজ।
জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই খাতের স্থানীয় উদ্যোক্তা এবং স্থানীয় উৎপাদিত মালামালকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের শর্ত থাকলেও আরইবি ওই কোম্পানির আবেদনে সেই শর্ত বাতিল করে দিয়েছে। কারণ হিসাবে জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতের সাবস্টেশনগুলো ভারতীয় একটি কোম্পানির কাছ থেকে কিনে আনা হবে। এতে দেশীয় কোম্পানিগুলোর তুলনায় পণ্যের মালিকানা প্রতিষ্ঠান বিদেশি কোম্পানিগুলো বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে। কারণ আমদানিকৃত পণ্যের জন্য তাদের কাস্টমস শুল্ক, ভ্যাট এবং কর দিতে হবে না। এতে বড় ধরনের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। এ অভিযোগের ব্যাখ্যায় আরইবি সিপিটিইউকে বলেছে, এই দরপত্রে বিশ্বব্যাংকের টেন্ডার ডকুমেন্ট অনুসরণের প্রয়োজন হয়নি। কারণ প্রকল্পটি প্রোগ্রাম ফর রেজাল্ট ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। আরও অভিযোগ আছে, এই প্রকল্পের ৩৩ কেভি জিআইএস সুইচ প্যানেল এবং ট্রান্সফরমারের কোয়ালিফিকেশন ক্রাইটেরিয়ার ওপর বিশেষ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এতে প্রতিযোগিতা সীমিত হয়েছে। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানসহ অনেক আন্তর্জাতিক দরদাতা অংশ নিতে পারেনি। দরপত্রে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুযোগ প্রদান এবং ৩৩ কেভি জিআইএস সুইচ গিয়ার প্যানেলের ক্ষেত্রে এবিবি চেক রিপাবলিকের প্রডাক্টকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) আব্দুর রহিম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, এই প্রকল্পের সঙ্গে তার সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আইডিয়ালের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তারা পেয়েছেন। কিন্তু সিপিটিইউ প্যানেল এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্প অফিসের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আইডিয়াল এন্টারপ্রাইজের মূল অভিজ্ঞতার সনদ ভারতীয় একটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা। অথচ কারিগরি মূল্যায়নে ওই অভিজ্ঞতা এককভাবে শুধু আইডিয়াল এন্টারপ্রাইজের নামে দেখানো হয়েছে। এটি বড় ধরনের জালিয়াতির শামিল বলে তিনি জানান। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পরপর ৩ বছরে কোম্পানিটির টার্নওভার মাত্র ২৭.৪৯ মিলিয়ন ডলার। লিকুইড অ্যাসেটের পরিমাণ ৭২.৭২ মিলিয়ন ডলার। এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানকে ৮শ কোটি টাকার কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ কতটা যুক্তিযুক্ত ও আইনসঙ্গত তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ধারা ৯৮ অনুযায়ী আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নপূর্বক সর্বনিম্ন দরপত্র নির্বাচন করার বিধান থাকলেও আরইবি আর্থিক মূল্যায়নে ওই ধারা অনুসরণ না করে, আর্থিক দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছে, যা সঠিক নয়।
জানা গেছে, আরইবির ৮শ কোটি টাকার সাবস্টেশন সরবরাহের দরপত্রটিতে আইটিটি ১৪.১(ন) শর্তানুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রধান কন্ট্রাক্টর হিসাবে গত ১০ বছরের ন্যূনতম ৭.৫ মিলিয়ন ডলার অথবা সমমূল্যের একটি টার্ন-কী কাজ (উৎপাদন, সরবরাহ, ইন্সটলেশন সব কাজ করবে) করার অভিজ্ঞতার শর্ত ছিল। এর অংশ হিসাবে সর্বনিম্ন দরদাতা আইডিয়াল এন্টারপ্রাইজ তাদের দরপত্রে ২টি অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে, তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি ডেসকোতে ভারতীয় টেসলা ট্রান্সফরমার কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চারে ৭৩ লাখ ডলারের একটি কাজ করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অভিজ্ঞতার সনদটিতে জয়েন্টভেঞ্চারের কোন কোম্পানি কতটুকু কাজ করেছে তার উল্লেখ নেই। সিপিটিইউ’র নিয়ম হলো এ ক্ষেত্রে জয়েন্টভেঞ্চারের দুটি কোম্পানির আলাদা কাজের তথ্য থাকতে হবে। কারণ আরইবি’র ৮শ কোটি টাকার এই সাবস্টেশন সরবরাহে এটি ছিল একমাত্র অত্যাবশকীয় শর্ত। শর্তটি দরদাতাকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে। জানা গেছে, সিন্ডিকেট ডেসকোর দেওয়া অভিজ্ঞতার সনদ থেকে ভারতীয় পার্টনারের কাজের অংশ বাদ না দিয়ে রহস্যজনকভাবে পুরো অংশটি আইডিয়ালের পক্ষে দেখানো হয়েছে। এভাবে তাদের কারিগরি মূল্যায়নে রেসপন্সিভ করা হয়।
অভিযোগ আছে, দরপত্র মূল্যায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার ক্যাপাসিটি অর্থাৎ অর্থনৈতিক চাহিদা যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করা হয়নি। দরপত্রের আইটিটি ১৫.১(ধ) ও ১৫.১(ন) শর্তানুযায়ী বার্ষিক টার্নওভার ও লিকুইড অ্যাসেট যোগ করে দরপত্র মূল্যায়ন করার কথা। কিন্তু ৩ বছরে কোম্পানিটি মাত্র ২৭.৪৯ মিলিয়ন ডলার টার্নওভার এবং ৭২.৭২ মিলিয়ন লিকুইড অ্যাসেটের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে ৮০০ কোটি টাকার কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ কতটা যুক্তিযুক্ত ও আইনসঙ্গত তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আহ্বানকৃত এই দরপত্রে দেশীয় অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ড বেশি দেখানোর শর্ত দেওয়া আছে। অথচ আইডিয়ালের লিখিত আবেদনের কারণে আরইবি বিশ্বব্যাংকের দেশীয় প্রিফারেন্স শর্তটি বাতিল করে দিয়েছে।