Image description
ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ

বেপরোয়া ছিনতাই। রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে খোদ রাজধানীতে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখা যাচ্ছে ভীতিকর দৃশ্য। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কোপানোর ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগে তৈরি করেছে নতুন মাত্রা। ঢাকায় খুন হয়েছেন চীনা নাগরিক। সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে চারদিকে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে অপরাধ দমাতে গেলে হামলার শিকার হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধীদের দমানো না গেলে অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের সক্রিয়তা জরুরি। কঠোর হতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পুলিশের উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রগুলো বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাও বলেছেন কেউ কেউ। 

চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণ
সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও দুই নারী যাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসটি ছাড়ার কিছু সময় পরেই আট থেকে ১০ জন ডাকাত চাকু, ছুরি ও পিস্তল নিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করে। এ সময় তারা দুই নারীকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ করেছেন ওই বাসের যাত্রীরা। বাসের চালক ও তার সহযোগীরা ডাকাতদের সহায়তা করেছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। 

শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে টাকা ও মোবাইল ছিনতাই: বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আবু রায়হান ইভান (২২) নামে এক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ সময় তার কাছে থাকা নগদ ৪৫ হাজার টাকা ও একটি দামি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। দুপুর ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। ইভান মালিবাগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স টেকনোলজি (বিআইএসটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।

যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘গোলাগুলি’র সময় দুই ব্যক্তি নিহত
ঢাকার মোহাম্মদপুরে যৌথবাহিনীর অভিযানে দুইজন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার ভোররাতে চাঁদ উদ্যান এলাকায় গোলাগুলিতে তারা নিহত হয়েছে। এ সময় অস্ত্র-গুলিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ বাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থলে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের সময় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা একটি গলির দুই পাশে ঘেরাও করলে সন্ত্রাসীরা একটি একতলা ভবনের ছাদ থেকে আভিযানিক দলটির ওপর অতর্কিত গুলি চালায়। আভিযানিক দলটি আত্মরক্ষার্থে তৎক্ষণাৎ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং পাঁচজন সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে বাড়িটিতে তল্লাশি চালিয়ে ছাদের ওপর থেকে দু’জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। 

প্রকাশ্যে কুপিয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা: সোমবার রাত ৯টায় উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে বাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফিরছিলেন মেহেবুল হাসান ও নাসরিন আক্তার ইপ্তি। পথিমধ্যে কয়েকজন কিশোরের সঙ্গে রিকশা আরোহীদের ঝামেলা দেখে সমঝোতার জন্য তারা এগিয়ে যান। যাদের সঙ্গে কিশোরদের ঝামেলা ছিল তারা সেখান থেকে দ্রুতই চলে যান। কিন্তু ওই কিশোররা উল্টো তাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ান। কথা কাটাকাটি ও বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে কিশোররা রামদা দিয়ে কোপাতে থাকেন তাদেরকে। ওই নারী পাশে থাকা পুরুষকে বাঁচানোর জন্য জীবন বাজি রেখে তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। কিন্তু নৃশংসভাবে নারীসহ ওই পুরুষকে কোপান কিশোররা। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
আদাবরে চাপাতি হামলা: মঙ্গলবার রাজধানীর আদাবরে প্রকাশ্যে চাপাতি নিয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তিন-চারজনের একটি দল রাসেল নামে এক যুবককে কুপিয়ে চলে যায়। জখম অবস্থায় ওই যুবক দীর্ঘ সময় রাস্তায় পড়ে ছিলেন। হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন তিনি। বাঁচার জন্য সাহায্য চাইছিলেন মানুষের কাছে। একপর্যায়ে আশপাশে থাকা কয়েকজন ব্যক্তি এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পুলিশ বলছেন, মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে।

অপরাধে লুটের অস্ত্র: গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের প্রায় ৪৬০টি থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ফাঁড়িতে একই ঘটনা ঘটায় দুর্বৃত্তরা। লুটপাটের সময় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথির পাশাপাশি লুট করা হয় সরকারি অস্ত্র। এসব অস্ত্র লুট করে কেউ কেউ নিজের কাছে রেখেছে, আবার কেউ সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা চরমপন্থি, উগ্রপন্থি, দাগি আসামি, সন্ত্রাসী, কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধীদের হাতে। লুট হওয়ার সাত মাস পরেও পুলিশ এসব অস্ত্র পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেনি।

লুট হওয়া ১৪০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি: সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লে. জে আব্দুল হাফিজ বলেছেন, ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে লুট হওয়া ১৪০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া আড়াই লাখ বিভিন্ন বোনেটের গুলিও উদ্ধার হয়নি। সন্ত্রাসীদের হাতে সেগুলো পড়তে পারে এবং তারা সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। ফলে এগুলো উদ্ধার করতে হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট করা হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৪ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার হলেও এখনো ১ হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র অপরাধীদের হাতে রয়েছে।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, এসকল অপরাধকে দমাতে প্রতিরোধ-প্রতিকার জরুরি। যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে সেগুলোকে তদন্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অস্ত্র লুট হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের বিষয়। জননিরাপত্তা রক্ষায় এসব অস্ত্র দ্রুত উদ্ধারে জোর দিতে হবে এবং অভিযান চলমান রাখতে হবে। এগুলো অপরাধীদের হাতে থাকা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি, ক্ষতি। লুট হওয়া অস্ত্র আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি। মারাত্মক, সেটি দুষ্কৃতিকারীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক বড় একটা ঝামেলার মধ্যদিয়ে গেছে, তাদের সেটি কাটিয়ে আরও কঠোর হতে হবে অপরাধ দমনে। 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মুনীরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, যখনই সরকারি অস্ত্র বা অন্য কোনো সরঞ্জাম হারিয়ে যায় তখন আর সেটি ফেরত পাওয়া যায় না। সেগুলো ভুল হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং নিরাপত্তার জন্য বড় শঙ্কা তৈরি করে। এগুলো আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি থাকবে। আর যতদিন পর্যন্ত সেগুলো উদ্ধার করা না যাবে সেই ঝুঁকি থেকে যাবে। অস্ত্র উদ্ধারে যে অভিযান চালানো হয়েছিল, সেটিতে পুরোপুরি অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। তাই আরও জোরদার অভিযান চালাতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান সময়ে অপরাধ প্রবণতা, ডাকাতি, অপহরণ, সহিংসতা, সংঘাত, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধগুলো অনেক কমে আসার কথা- এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছি। কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। একটি রাজনৈতিক দলের সরকারের পতনের পর নতুন যে অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছেন তাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হয়নি। দেশে একটি চক্রই তৈরি হয়েছে যারা অপরাধটি তার আয়-উপাজর্নের উৎস মনে করছে। তিনি বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই বলছেন তারা এখনো পরিপূর্ণভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারছে না; তবে আগের থেকে মাত্রা বেড়েছে। দেশে সামান্যতম পরিস্থিতি তৈরি হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে আমরা যতই আলোচনা-সমালোচনা করি না কেন, তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। সেই নির্ভরতার জায়গা থেকে তাদের যে জুলাই বিপ্লবের পরে পূর্ব-প্রস্তুতি, অবস্থান-মর্যাদা, নৈতিক মনোবল বা সংকটকে দূরীভূত করার প্রস্তুতি বা এই অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করার জন্য যে ব্যবস্থা, মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ের যে সমন্বয়টা এই জায়গাতে ঘাটতি রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, সবকিছু মিলিয়ে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বড় কোনো ঘটনা নেই। ল’ অ্যান্ড অর্ডার ভেরি গুড। আমি মনে করি বিচ্ছিন্ন একটি-দু’টি, মেইনলি মোবাইল ছিনতাই ব্যতীত কোনো অপরাধ নেই। এভরিথিং ইজ নরমাল। তিনি বলেন, দু’দিন আগে উত্তরার ঘটনার পাঁচজনকেই অ্যারেস্ট করা হয়েছে। আমরা সাকসেসফুললি ওইটা হ্যান্ডেল করছি। আমার অফিসার, ফোর্স সবাই আমরা মনোবল ফিরে পেয়েছি এবং চমৎকারভাবে কাজ করছি।

আইনজীবী কে এম মাহফুজ মিশু মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে। এটি নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে- এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকে কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে পুলিশও সহযোগিতা করছে না। কারণ তাদের মধ্যে এখনো ভীতি রয়েছে। যেসকল অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের আদালতে পাঠানোর পরে তারা যেন জামিন না পায় সেই বিষয়ে কোনো আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিদের একটু সজাগ থাকা উচিত। এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে তাহলে মানুষ আরও ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাবে। অপরাধের তুলনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উন্নতি এবং যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তারা যেন কোনোভাবে জামিন না পায়। 

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এটি সংখ্যায় কখনো কমে আবার কখনো বাড়ে। দেশে সকল অপরাধের মাত্রা যাতে কমিয়ে আনা যায় এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে।