
পরিকল্পিত নগর রাজশাহীতে উন্নয়নের চমক দেখিয়ে হরিলুট করেছেন সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। ক্ষমতায় বসেই প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেন তিনি। এরপর রেট শিডিউলের তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছামতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। অনুমোদন না নিয়েই ৫৩৬ কোটি টাকার টেন্ডার করেছেন।
দেড় কোটি টাকার কাজ করেছেন সোয়া দুই কোটি টাকায়। বেশির ভাগ কাজে সরকারি রেট শিডিউলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করেছেন। নতুন রেট শিডিউলের দোহাই দিয়ে সব খাতে বেশি খরচ করেছেন। প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে ৬০০ কোটি টাকার কাজ বাদ দিয়ে ব্যয় কমানো হয়েছে মাত্র ২০ কোটি টাকা।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) এম এ আকমল হোসেন আজাদের সভাপতিত্বে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পটির বিভিন্ন খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবসহ বিভিন্ন অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পের আওতায় অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাত বাদ দেওয়ার পাশাপাশি ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে ডিপিপি পুনর্গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে এম এ আকমল হোসেন আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনগণের টাকা অপচয়ের সুযোগ নেই। কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় প্রস্তাব অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তাই প্রস্তাবিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া গাড়ি কেনাসহ প্রকল্পের আওতায় কিছু অপ্রয়োজনীয় খাত ছিল, সেগুলো বাদ দিতে বলা হয়েছে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরের অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর জুনে। তবে এখনো প্রকল্পের প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ বাকি। ফলে মেয়াদ বাড়াতে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে ‘রাজশাহী মহানগর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে অনুমোদন পায়। গত বছরের জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই হাজার ৯৩১ কোটি ৬১ লাখ টাকার এই প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছে এক হাজার ৯৭৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৬৭.৯৩ শতাংশ। আর প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৭১ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে বাকি কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়াতে গত ডিসেম্বরে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব দেয় রাসিক। এতে কিছু অপ্রয়োজনীয় কাজ বাদ এবং কিছু ক্ষেত্রে কাজের পরিধি কমবেশি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এসব কারণে প্রকল্পের মোট ব্যয় থেকে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা কমানোর প্রস্তাবও করা হয়। এ বিষয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, অপ্রয়োজনীয় খাত বাদ দিয়ে প্রকল্প থেকে অর্থ সাশ্রয় করা হচ্ছে।
রাসিকের সংশোধনী প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ বাদ এবং পরিধি কমানোর কারণে ব্যয় কমার কথা ৬০০ কোটি টাকার বেশি। অথচ সংশোধনী প্রস্তাবে মাত্র ২০ কোটি টাকা কমিয়ে বাকি প্রায় ৫৮০ কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে। কোন কোন খাতে এই ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় সব খাতেই ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিছু খাতে কাজ কমলেও সেখানেও বেশি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাতের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ৯৯.৫৬ কিলোমিটার কার্পেটিং সড়ক নির্মাণের জন্য খরচ ধরা ছিল ১৪৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবে সড়কের দৈর্ঘ্য মাত্র ২.৫৯ কিলোমিটার বাড়িয়ে ১০২.১৫ কিলোমিটারের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২৪৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র আড়াই কিলোমিটার সড়কের জন্য খরচ বাড়ানো হয়েছে ১০২ কোটি তিন লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্পের আওতায় ১৪৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এরই মধ্যে ৬৪.৭৮ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ করা হয়েছে। সেখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা, অথচ খরচ ধরা ছিল এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ৭৮ লাখ টাকা বেশি খরচ করা হলেও এর জন্য কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। শুধু এই খাতে নয়, অন্য সব খাতেও পূর্বানুমোদন ছাড়াই বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ করা হয়েছে।
প্রকল্প অনুমোদনের সময় ১৩.১০ কিলোমিটার চার লেনের সড়ক নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১৯৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। কিন্তু নতুন প্রস্তাবে মাত্র ৩১ মিটার বাড়িয়ে খরচ চাওয়া হয়েছে ২১৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৩১ মিটারের জন্য ১৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বেশি চাওয়া হয়েছে।
ব্যয় বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, শুধু কাজের পরিমাণ সামান্য বাড়িয়েই অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব করে থামেননি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, কিছু ক্ষেত্রে কাজ কমিয়েও চাওয়া হয়েছে বেশি খরচ। প্রকল্প অনুমোদনের সময় ১০৬ কিলোমিটার কার্পেটিং সড়ক পুনর্নির্মাণে বরাদ্দ ছিল ৮৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, নতুন প্রস্তাবে ২৭ কিলোমিটারের কাজ কমলেও ১৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা বেশি খরচ চাওয়া হয়েছে।
শুধু সড়ক নির্মাণ নয়, অন্যান্য খাতেও অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করার তথ্য মিলেছে। প্রকল্পের আওতায় ১৫৯ কিলোমিটার কালভার্ট নির্মাণে বরাদ্দ ছিল এক কোটি ৫৭ লাখ টাকা। সংশোধনীতে ১৮৭ কিলোমিটারের জন্য চাওয়া হয়েছে চার কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আগের হিসাবে মিটারপ্রতি খরচ ছিল ৯৮ হাজার ৫০১ টাকা, অথচ নতুন প্রস্তাবে এক লাখ ৫৭ হাজার ১৭৮ টাকা বাড়িয়ে মিটারপ্রতি খরচ ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৫ হাজার ৬৯৭ টাকা।
দুই হাজার ৫৫০.৬ বর্গমিটারের দুটি তিনতলা ওয়ার্ড কার্যালয় ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণে বরাদ্দ ছিল ৯ কোটি আট লাখ ৩৭ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি বর্গমিটারে খরচ ধরা ছিল ৩৫ হাজার ৬১৩ টাকা। কিন্তু নতুন প্রস্তাবে আয়তন কমানো হলেও খরচ প্রায় তিন গুণ বাড়িয়ে দুই হাজার ১১৬ বর্গমিটারের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ৮২ হাজার ৩৪৪ টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ১৭ হাজার ৯৫৭ টাকা চাওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া এক হাজার ৩০০ বর্গমিটারের অফিসার্স ক্লাব নির্মাণে বরাদ্দ ছিল চার কোটি ২২ লাখ টাকা, নতুন প্রস্তাবে কাজের পরিমাণ একই থাকলেও দুই কোটি ৫৮ লাখ টাকা বেশি চাওয়া হয়েছে। ৯ হাজার ৬৫১.৯১ বর্গমিটারের তিনতলা ভদ্রা কাঁচাবাজার নির্মাণে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি টাকা। সংশোধিত প্রস্তাবে সাড়ে চার হাজার বর্গমিটারের কাজ কমলেও খরচ বেড়েছে ১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২৫ কিলোমিটার পানি সরবরাহ লাইন স্থানান্তরে বরাদ্দ ছিল পাঁচ কোটি টাকা, নতুন প্রস্তাবে মাত্র দেড় কিলোমিটার কাজ বাড়িয়ে খরচ চাওয়া হয়েছে ৯ কোটি টাকা। ১৩ কিলোমিটার গ্যাস লাইন স্থানান্তরে বরাদ্দ ছিল ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা, নতুন প্রস্তাবে চাওয়া হয়েছে আট কোটি ২০ লাখ টাকা। সম্প্রসারিত সিটি গ্যারেজ নির্মাণে একই কাজের জন্য তিন কোটি ৯ লাখ টাকা বেশি চাওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ১৯টি জলাশয়ের সৌন্দর্যবর্ধনে বরাদ্দ ছিল ১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, নতুন প্রস্তাবে ১১টি বাদ দিয়ে আটটি জলাশয়ের জন্য খরচ চাওয়া হয়েছে ২০ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ১৫টি গণশৌচাগার নির্মাণে বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৫৯ লাখ টাকা; কিন্তু নতুন প্রস্তাবে ১৩টির জন্য চাওয়া হয়েছে পাঁচ কোটি ৭১ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন নির্মাণে ছয় কোটি ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধনীতে খরচ ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ভুবন মোহন পার্ক নির্মাণে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা বেশি চাওয়া হয়েছে।
প্রায় সব খাতেই অস্বাভাবিক এই ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে রাসিক বলছে, রেট শিডিউল পরিবর্তন এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে ব্যয় বেড়েছে। সংস্থাটি আরো বলেছে, ২০১৮ সালে রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী কাজ করার কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনুমোদিত প্রকল্পের কাজ এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন করতে হলে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সেটা মানা হয়নি। রেট শিডিউল পরিবর্তন করে কাজ করা এবং বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ করা হলেও পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন নেওয়া হয়নি, যা নিয়মের লঙ্ঘন।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিকল্পনা কমিশনের আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। নিজেদের পকেট ভারি করতে এবং ঠিকাদারদের সুবিধা দিতে এমনটা করা হতে পারে। সংশোধনী প্রস্তাবে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার, যাতে জনগণের টাকা অপচয় করে লুটপাট করা না হয়।
রাশিকের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সাবেক মেয়র লিটন নিজের ইচ্ছামতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। নিজের কাছের লোকদের কাজ দিয়েছেন। প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে বেশি ব্যয় ধরে সেই টাকা নিজের পকেটে পুরেছেন।
কারো অনুমোদন না নিয়ে প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও রাসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহমুদুর রাহমান কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সাবেক মেয়রের ক্ষমতার প্রভাবে নিজেদের ইচ্ছামতো খরচ করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মো. মামুন আল রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন ছাড়া অনুমোদিত প্রকল্প থেকে কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। অনুমোদন ছাড়া রেট শিডিউলে পরিবর্তন করে কাজ করে থাকলে সেটার বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। এসব অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। পরিকল্পনা কমিশনের উচিত প্রস্তাবগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করা এবং অপ্রয়োজনীয় খাতগুলো বাদ দেওয়া। একই সঙ্গে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এ ধরনের অনিয়ম চলতেই থাকবে।