
রংপুরে হাই-টেক পার্ক নির্মাণের জন্য যখন ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়, তখন প্রযুক্তিপ্রেমী তরুণেরা স্বপ্নে বুক বেঁধে ছিলেন কর্মসংস্থান হবে, নিজেদের তৈরি প্রযুক্তি রপ্তানি হবে, হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু সে স্বপ্নের ছোঁয়া এখনো পাননি রংপুরে তরুণেরা। কারণ দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ হয়নি হাই-টেক পার্ক নির্মাণকাজ। সাড়ে ৭ বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খোঁজ মিলছে না ভারতীয় ঠিকাদারের। এতে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. রবিউল ফয়সাল বলেন, ‘হাই-টেক পার্কের কাজ শুরু করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ আবার চালু হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১২টি হাই-টেক পার্ক নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। রংপুর হাই-টেক পার্কের ব্যয় ধরা হয় ১৫৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রংপুর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের খলিশাকুড়ি এলাকায় ১০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে জেলা প্রশাসন। ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ পায় ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলঅ্যান্ডটি।
২০২০ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সাইনবোর্ডেই ঝুলে ছিল প্রকল্প নির্মাণকাজ। এরপর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন মাস করা হলেও কাজ শুরু করতে অনেক দেরি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালের মে মাসে হাই-টেক পার্কের কাজের উদ্বোধন করা হয়। এ অবস্থায় মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুলাই করা হয়। এ সময়ের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলঅ্যান্ডটি।
এ প্রসঙ্গে রংপুরে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর তরুণ উদ্যোক্তা ইনবক্স আইটি সলিউশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবু সায়েম বলেন, ‘রংপুরের তরুণদের জন্য হাই-টেক পার্ক ছিল এক স্বপ্ন। যেখানে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, প্রযুক্তি খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশীয় প্রযুক্তি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করবে। কিন্তু নির্মাণকাজের দীর্ঘসূত্রতা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতায় এ স্বপ্ন এখনো বাস্তবে রূপ নেয়নি। রংপুরের তরুণেরা শুধুই প্রতিশ্রুতির অপেক্ষায় থাকতে পারেন না। আমরা চাই, হাই-টেক পার্কের কাজ দ্রুত শেষ হোক এবং প্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হোক।’
সরেজমিনে দেখা যায়, হাই-টেক পার্কের পুরো এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নির্মাণসামগ্রী। অলস পড়ে রয়েছে ক্রেনসহ ভারী সব যন্ত্রপাতি। পুরো এলাকায় আছেন হাতে গোনা কয়েকজন নিরাপত্তাপ্রহরী।
এ প্রতিনিধির ছবি তোলা দেখে এগিয়ে এসে খলিশাকুড়ি এলাকার বাসিন্দা অনিল রায় বলেন, ‘জমিগুলো নিয়া বালা তুলি রাখছে। এটে আর কত দিন লাগবে বিল্ডিং হইতে। এটা কবে চালু হবে। বছরের পর বছর কি এমতোনে থাকবে। তাহলে তো ফসল আবাদই ভালো ছিল।’
কথা হলে নিরাপত্তাপ্রহরী এনামুল হক বলেন, ‘সবশেষ কাজ হয়েছে গত বছরের ২ আগস্ট। আওয়ামী সরকার পতনের পর কাজ বন্ধ করে চলে গেছেন ভারতীয় ঠিকাদার। কবে কাজ শুরু হবে, তা জানি না। এখানে চার ভাগের একভাগ কাজ হয়েছে। মালপত্র আনা হয়েছে। আমরা চার-পাঁচজন নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদুজ্জামান নাহিদ বলেন, ‘বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তি নিয়ে ব্যস্ত, আমরা তখন পাঠ্যবইয়ে এইচটিএমএল, সিএসএস নিয়ে পড়ে আছি। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উদ্ভাবন, কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন ব্যবহারিক শিক্ষার। এ ক্ষেত্রে হাই-টেক পার্কের বিকল্প নেই। হাই-টেক পার্ক চালু হলে প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে আমরা বিশ্ববাজারে আমাদের নিজস্ব প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারব।’
রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৫ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে রংপুরের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। রংপুরে তরুণসমাজকে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। তা না হলে শিক্ষিত তরুণদের জ্ঞান কাজে লাগানো সম্ভব হবে না; বরং বেকারত্ব বাড়বে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ইলিয়াস প্রামাণিক বলেন, হাই-টেক পার্ক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আইটি খাতে গবেষণার সুযোগ পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবের যে সংকট রয়েছে, তা পূরণ করা যাবে। তা ছাড়া রংপুর অঞ্চলের তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। না হলে শিক্ষার্থী-তরুণেরা বঞ্চিত হবে। যে উদ্দেশ্যে এটি করা হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন হবে না।
রংপুর হাই-টেক পার্কের কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মো. মনির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ৫ আগস্টের পর কাজ বন্ধ ছিল। সবাই আতঙ্কের কারণে বাড়িতে ছিল। এ মাসে কাজ শুরু হয়েছে। এখন পুরোদমে কাজ চালু হয়ে যাবে।