
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদস্যদের নিজেদের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা, অপরাধ নজরদারি ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য নেওয়া একটি প্রকল্পের কাজ শেষে ১৫ বছরেও চালু হয়নি। ২০০১ সালে অনুমোদিত ১০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে শেষ হলে পুলিশ গ্রহণও করেছিল। কিন্তু নানা জটিলতা তৈরি করে প্রকল্প চালু আটকে রাখা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প শেষ হলেও শুধু রাজনৈতিক কারণে ১৫ বছর প্রকল্পটি চালু করা হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রকল্পটি নেওয়ার কারণে কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা জটিলতা তৈরি করে এটি আটকে রেখেছিলেন। সম্প্রতি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন করলে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
বাংলাদেশ পুলিশের সূত্র বলেছে, প্রকল্পটি চালু হলে রাজধানীর যানজট নিরসন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং পুলিশের কার্যকারিতা সহজে বাড়ত। এর সুফল পেত রাজধানীবাসী।
প্রকল্পটি চালু না হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির শিকার হওয়ার দাবি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি রাফা ট্রেডিং লিমিটেড। তারা প্রতিকার পেতে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার কথা জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ডিএমপির জন্য ‘আধুনিক কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ স্থাপনে ২০০১ সালে ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়। ২০০৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে আব্দুল গণি রোডে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ (কন্ট্রোল রুম) স্থাপন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় ১৫৫টি সিসিটিভি ক্যামেরা, ৩১টি ট্রাফিক ডিসপ্লে বোর্ড, নিয়ন্ত্রণকক্ষে ৩৫টি মনিটর, ৩০টি এভিএল সিস্টেমসংবলিত থানার টহল গাড়ি এবং ১ হাজার ৫০০টি টেট্রা ওয়াকিটকি হ্যান্ডসেট দেওয়া হয়। এগুলোর সাহায্যে ওই নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে পুরো ঢাকা শহরের অপরাধ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নজরদারি করা সম্ভব ছিল।
সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের আওতায় ডিএমপির জন্য আধুনিক ডিজিটাল কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এবং মাল্টি সাইট ডিজিটাল ট্রাঙ্কিং ওয়্যারলেস সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল। এতে সিসিটিভি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অপরাধ ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বার্তার মাধ্যমে ট্রাফিক অবস্থা জানা, ৯৯৯-এ ফোন করার সুবিধা এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির লোকেশন সিস্টেমের মাধ্যমে থানার মোবাইল গাড়ির অবস্থান জানার সুবিধা ছিল।
ওই সময় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে কাজ করা একজন পরিদর্শক বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবেই ওই প্রকল্পের ট্রাফিক সংকেতের কাজ ভালোভাবে চলেছিল। আমরাও ভেবেছিলাম আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু তা কেন শেষ পর্যন্ত এগোলো না, তা জানি না।’
প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের জন্য মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু পরে রাজধানীতে একের পর এক সুউচ্চ ভবন ওঠায় মাইক্রোওয়েভ সিগন্যালের কার্যকারিতা কমে যায়। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিটিসিএলের ফাইবার অপটিকের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থা পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। পরে পুরো প্রকল্প ফাইবার অপটিকের সংযোগের আওতায় নেওয়া হয়। ২০১০ সালে কাজ শেষে পুলিশ প্রকল্প গ্রহণ করলেও এরপর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য চলতে থাকে চিঠি চালাচালি। কিন্তু সেই উদ্বোধন আর হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ওই প্রকল্পের অধীনে স্থাপিত সরঞ্জাম কার্যকর থাকলেও কিছু পুলিশ কর্মকর্তা ব্যবস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না করে ফেলে রাখেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদে কয়েকজন বসলেও প্রকল্পটির ভাগ্য খোলেনি। বিগত সরকারের আমলে আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। প্রস্তুত প্রকল্প চালু না করে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশ টেলিকমের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মালামাল কিনেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, গত ১০ বছরে রাজনৈতিক প্রভাবের সুযোগ নিয়ে ওই সিন্ডিকেট নির্দিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার যোগাযোগ সরঞ্জাম কিনেছে। অথচ এই প্রকল্প চালু করলে খরচ বাঁচত। প্রকল্প শেষ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও পুরো বিল পায়নি।
জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু পরিবর্তন করে ফেলা হয়। এর মাধ্যমে একটি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা খোঁজা হয়। কোনটাতে জনগণের ভালো হবে, সেটা চিন্তা না করে সবকিছু রাজনৈতিক করে ফেলা হয়।’
বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কাউকে পাওয়া যায়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ আত্মগোপনে, কেউ রয়েছেন কারাগারে। তাই তাঁদের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ওই প্রকল্পের ঠিকাদারের স্থানীয় প্রতিনিধি রাফা ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাকারিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সিদ্ধান্তহীনতার কারণে পৃথিবীর অত্যাধুনিক এই কমান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমের শতভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরও কার্যক্রম চালাতে পারেনি। এতে একদিকে তিনি আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন, অন্যদিকে তাঁর সঙ্গে যেসব বিদেশি কোম্পানি কাজ করত, তারা বিরূপ ধারণা নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়েছে। তিনি বলেন, এখন সময় বদলেছে। তিনি আর্থিকভাবে যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তার প্রতিকার পেতে সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেবেন।