
এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠদের মিলেমিশে লুটপাটের বড় এক প্রকল্প। শীর্ষ পদ প্রকল্প পরামর্শক থেকে শুরু করে ই-নথি ইমপ্লিমেন্টেশন এক্সপার্ট—মোট ১৪ শীর্ষ কর্মকর্তা যথেচ্ছাচারের এক আখড়া ছিল এটুআই প্রকল্প। তাদের বিরুদ্ধে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ক্রয় প্রক্রিয়ায় ব্যাপক লুটপাট, অর্থপাচার, বিদেশে সফর, সম্পদ অর্জন, ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, অবৈধ বিল/ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ নিয়োগ, নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, রাজনৈতিক দলের প্রচার চালানো এবং দল বেধে নাইট ক্লাবে গিয়ে নেশায় মত্ত থাকাসহ একগাধা অভিযোগ ওঠে। পরে এসব অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচি শুরু করে। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৮ সালে এটুআই প্রোগ্রামকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে নেওয়া হয়।
২০২০ সালে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের নাম পরিবর্তন করে এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) রাখা হয়। পরে সেটিকে ‘এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই) বিল-২০২৩’ নামে বিল হিসেবে সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে তোলা হয় এবং বিলটি পাসও হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথমে প্রকল্পের মূল ব্যয় ধরা হয় ৪৮৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের ব্যয় ছিল ৪০৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। আর সহায়তা তহবিল থেকে আসার কথা ৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কিন্তু এই প্রাক্কলিত ব্যয় সংশোধিত হলে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৮৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের ব্যয় ৪০৩ কোটি ৬৫ লাখ থেকে বেড়ে ৫৫৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হয়। আর সহায়তা থেকে আসা ব্যয় ৮১ কোটি ৮০ লাখ থেকে বেড়ে ৩০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা দাঁড়ায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউএনডিপির সহায়তা কর্মসূচি হওয়ায় শীর্ষ পরামর্শকদের অধিকাংশ তারা নিয়োগ দিয়েছে। যদিও তা সরকারের পরামর্শেই। আর কনসালটেন্ট নিয়োগ দিয়েছে তৎকালীন সরকার। সব মিলিয়ে এটুআই আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠদের মিলেমিশে লুটপাটের প্রকল্প হয়ে ওঠে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভুত্থানের পর এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অসুদপায় অবলম্বন করে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ২০ আগস্ট তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে একই বছরের ২০ অক্টোবর সেই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই অনুযায়ী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি বাংলা আউটলুকের হাতে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল নাগরিক-কেন্দ্রিক উদ্ভাবন সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের এসডিজি অর্জনকে দ্রুততর করা; সরকারি সেবাসমূহের ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে সময়, খরচ এবং যাতায়াত কমিয়ে সুশাসনে সততার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহযোগিতা প্রদান; সরকারের মধ্যে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা; ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম তৈরিতে সহায়তা প্রদান এবং দরিদ্র-বান্ধব ডিজিটাল আর্থিক সেবা উদ্ভাবনের সুযাগ সৃষ্টি করা এবং সেবার উন্নয়ন, ডিজিটাইজেশন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা।
জানা যায়, অতিরিক্ত সচিব ড. মো. আবদুল মান্নান ২০১৯ সালের ৪ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, যুগ্মসচিব ড. মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত সচিব মো. মামুনুর রশীদ ভূঞা ২০২৩ সালের ২৩ জুলাই থেকে এখনো পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক আছেন।
ওই ১৪ কর্মকর্তা কারা এবং তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
ইউএনডিপির নিয়োগকৃত প্রকল্প পরামর্শক আনীর চৌধুরী দেশের আইসিটি সেক্টরের অপকর্মের মূল হোতা। শুরু থেকে তিনি এটুআই প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন। তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে। অভিযোগ আছে, তার পরিবার পরিজন আমেরিকাতে বসবাস করেন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পলকেরও ঘনিষ্ঠ। তিনি আওয়ামী লীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে সিআরআইয়ের সক্রিয় সদস্য। জয় ও পলকের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ইউএনডিপি ও এটুআইয়ের উপর তার ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করেছেন তিনি। ফলে এটুআইয়ের সব ভালো মন্দ কাজের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ ছিল।
এছাড়া ই-গভর্মেন্ট এনালিস্ট হিসেবে ফরহাদ জাহিদ শেখ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে মো. মাজেদুল ইসলাম, প্রজেক্ট এনালিস্ট (এইচডি মিডিয়া) হিসেবে পূরবী মতিন, ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে মানিক মাহমুদ, রিসোর্স মোবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে মো. নাসের মিয়া, ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস স্পেশালিস্ট হিসেবে তহুরুল হাসান টুটুল, সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট হিসেবে রেজওয়ানুল হক জামী এবং টেকনোলজি এনালিস্ট হিসেবে মো. হাফিজুর রহমানকে নিয়োগ দেয় ইউএনডিপি।
ফরহাদ জাহিদ শেখের বিরুদ্ধে কোভিডের সময় ডাক্তারদের টাকা এবং প্লাটফর্ম তৈরির টাকা আত্মসাৎ করে বিভিন্ন স্থানে জমি/ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তার পরিচিত প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়ে অবৈধভাবে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ এবং নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগ ছিল।
প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মাজেদুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির টাকায় বিদেশ সফর, অফিস শেষে সহকর্মীদের নিয়ে ক্লাবে নেশায় মত্ত থাকা এবং নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ ছিল।
প্রজেক্ট এনালিস্ট (এইচডি মিডিয়া) পূরবী মতিনের বিরুদ্ধে আনীর চৌধুরীর সহায়তায় প্রচারণামূলক কাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও এটুআইতে কর্মরত থেকে নিজের টিমের মাধমে অবৈধভাবে রাজনৈতিক দলের প্রচারণার অভিযোগ ছিল।
ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদের বিরুদ্ধে অবাস্তব প্রকল্প প্রস্তাব উদ্যোগ গ্রহণের জন্য উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের চাপ দেওয়া, নারী উদ্যোক্তা/সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ ছিল।
রিসোর্স মোবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট নাসের মিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্রয় প্রক্রিয়ায় ভেন্ডরদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং কাজ পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিলাসবহুল জীবনযাপনের অভিযোগ ছিল।
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস স্পেশালিস্ট তহুরুল হাসান টুটুলের বিরুদ্ধে জনগণের টাকা ব্যবহার করে পেমেন্ট গেটওয়ে তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ, দুবাইতে অর্থ পাচার, কর্মশালা আয়োজনের নামে অর্থ আত্মসাৎ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল।
সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামীর বিরুদ্ধে এটুআইকে ব্যবহার করে ই-কমার্স বাণিজ্যে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি কাজে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ এবং অবৈধ সাহায্যের জন্য আত্মীয়দের ব্যবহারের অভিযোগ ছিল।
টেকনোলজি এনালিস্ট হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্রয় প্রকিয়ায় অনিয়ম এবং ভেন্ডরদের নিকট হতে সুবিধা নেওয়া, আনীর চৌধুরীকে সরকারি গোপন নথি এবং তথ্য দিয়ে সাহায্যের অভিযোগ ছিল।
অন্যদিকে, কনসালটেন্ট (এডিমন) হিসেবে মো. ওমর ফারুক, সিনিয়র কনলাসটেন্ট হিসেবে আসাদ-উজ-জামান, সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তানভীর কাদের ইমন, সিনিয়র প্রকিউরমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন এবং ই-নথি ইমপ্লিমেন্টেশন এক্সপার্ট হিসেবে এটিএম আল-ফাত্তাহকে নিয়োগ দেয় সরকার।
এদের মধ্যে ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে অবৈধ বিল/ভাউচারের মাধমে অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ অর্থে বিদেশ সফর এবং ব্যাপক সম্পদ অর্জন; আসাদ-উজ-জামানের বিরুদ্ধে দক্ষতা উন্নয়নের নামে ইভেন্ট আয়োজন করে কোটি কোটি টাকা আত্মাসাৎ, নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন; তানভীর কাদের ইমনের বিরুদ্ধে ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়মের মাধ্যমে অযোগ্য সেবা প্রদানকারীকে সুবিধা দেওয়া, আনীর চৌধুরীকে সরকারি গোপন নথি, ডাটা এবং তথ্য সরবরাহ; মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ক্রয় (প্রকিউরমেন্ট) প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং এটিএম আল-ফাত্তাহ’র বিরুদ্ধে নথি সিস্টেমের জন্য একই ভেন্ডরকে বার বার কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সহায়তা এবং কর্মশাল/প্রশিক্ষণের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অধিকাংশের সত্যতা পাওয়া যায়। আর কিছু কিছু অভিযোগের ব্যাপারে সত্যতা নিশ্চিতে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। ইউএনডিপির নিয়োগকৃত কর্তা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রাথমিক ওই তদন্ত প্রতিবেদন সংস্থাটিতে পাঠানো হয়েছে। ইউএনডিপি অধিকতর তদন্তের জন্য ওই প্রতিবেদনটি অফিস অব অডিট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনে (ওএআই) পাঠিয়েছে। সেই তদন্ত চলমান রয়েছে এবং এখনো সেই তদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এদিকে, ইউএনডিপির নিয়োগকৃত এই পরামর্শকদের মধ্যে দুইজন ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। আর সাতজনকে সংস্থাটি সব ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত রেখেছে। আর নিজেদের অর্থায়নে নিয়োগকৃত ৫জন কনসালটেন্টের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে সরকার।
৫ আগস্টের পর ওই ১৪ জন ছাড়াও এটুআইয়ের বিভিন্ন পদে কর্মরত ৩৫ জন কনসালটেন্টের মধ্যে ১৭ জনের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। বাকি ১৮ জন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন বলে অনুসন্ধানে দেখা যায়।