Image description
 

জাতিসংঘ তদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা চিহ্নিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের জন্য এ প্রতিবেদন একটি অকাট্য দলিল।

আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে মানবাধিকার কর্মী, আইন বিশেষজ্ঞ, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটে, সেজন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।

ভারতে অবস্থান করা শেখ হাসিনাসহ তার সহযোগীদের জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে জাতিসংঘ তদন্ত রিপোর্টে। শেখ হাসিনার বিচারের জন্য অভ্যন্তরীণ উদ্যোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উদ্যোগও জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন তারা। পাশাপাশি প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।

উল্লেখ্য, জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রকাশিত রিপোর্টে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বীভৎস্য চিত্র ফুটে উঠেছে। বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় জুলাই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৪০০ মানুষ, যার মধ্যে ১৩ শতাংশই শিশু। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জঘন্য ওই হত্যাকাণ্ডে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরাসরি যুক্ত ছিল। আন্দোলন দমাতে দলটির সশস্ত্র নেতাকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে মিলে জুলাই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে জাতিসংঘ রিপোর্টে উঠে এসেছে।

জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা যে বাহিনীর হোক না কেন, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে বলে মনে করেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম মনিরুজ্জামান। জাতিসংঘ রিপোর্ট নিয়ে আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, এই রিপোর্টটি একটি নিরপেক্ষ রিপোর্ট। জাতিসংঘ টিম মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে এই রিপোর্ট তৈরি করেছে। আমাদের অবশ্যই রিপোর্টটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। কোনো বাহিনীই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সব বাহিনীকে আইনের মধ্য থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাতিসংঘের রিপোর্টে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার।

শেখ হাসিনার বিচারের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে জেনারেল মনিরুজ্জামান বলেন, রিপোর্টটি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনা এখন যেহেতু অন্য দেশে রয়েছে, তাই তার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের রিপোর্টে যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে তা শেখ হাসিনার একার পক্ষে পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না বলে মন্তব্য করে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, এ রিপোর্টের সূত্র ধরে জুলাই হত্যাকাণ্ডের উৎসের দিকে আমাদের যেতে হবে। জাতিসংঘ রিপোর্টে সব কিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়েছে। শুধু হত্যাকাণ্ডে ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি আসেনি। কূটনৈতিক কারণে জাতিংঘের পক্ষে ভারতের নাম নেয়াটা সম্ভবও নয়। আমরা জানি, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকরাও জানে যে, জুলাই বিক্ষোভ দমনে ভারত কীভাবে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

তিনি বলেন, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা হাসিনা সরকারের সঙ্গে মিলে জুলাই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। জাতিসংঘের রিপোর্টটি নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মুভ করা উচিত। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হবে জাতিসংঘের রিপোর্টটি বিশ্বদরবারে তুলে ধরা। শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়ে আরত যে হত্যাকাণ্ডের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। শেখ হাসিনার বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনও আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে শেখ হাসিনা তার সহযোগী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন এ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।

বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান জুলাই হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় আখ্যা দিয়ে আমার দেশকে বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনা আমরা নিজ চোখে দেখেছি। সারা বিশ্বও দেখেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের জঘন্য ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। এবার জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও আমরা তার প্রতিফলন পেলাম। জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর প্রমাণিত হলো জুলাই হত্যকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যা বলছে, তা মিথ্যা নয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে পুলিশের তদন্ত ম্যানিপুলেট হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। জাতিসংঘ নিরপেক্ষ চিত্র তুলে ধরেছে। ওই প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার আমলের দুঃশাসনের চিত্র ফুটে উঠেছে। আমি মনে করি, জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করে বিচার শুরু করতে হবে। দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আমাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে।

বাংলাদেশের তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আইনজীবী এলিনা খান বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে তৈরি করা জাতিসংঘের রিপোর্টে পুরো বিষয়টি উঠে এসেছে। আমার প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ খুব কম সময়ে এত বড় একটি রিপোর্ট তৈরি করতে পারল, অথচ বাংলাদেশের তদন্তকারীরা একটা চার্জশিট দিতে পারল না। এটা দুঃখজনক।

এলিনা খান জাতিসংঘ রিপোর্টের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, বিভিন্ন বাহিনীসহ বিচার বিভাগ সংস্কারের যেসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে, তার দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে যেসব সুপারিশ এসেছে, দলগুলোকে তা আমলে নিতে হবে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এ সুপারিশ বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

জাতিসংঘ নিরপেক্ষ চিত্র তুলে ধরেছে উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এলিনা খান বলেন, জাতিসংঘের এ রিপোর্ট দেখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে বোধোদয় হওয়াটা জরুরি। তাদের বোঝা উচিত, তাদের দলের পক্ষ থেকে কী জঘন্য ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তিনি বলেন, জাতিসংঘ রিপোর্ট প্রকাশে ভারতেরও বোধোদয় হবে বলে আমি আশা করি। কারণ ভারত জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে।

জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনকে অকাট্য দলিল উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অকাট্য দলিল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ ও গুরুতর আহতসহ অনেক বিক্ষোভকারীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি দিয়েছে ওএইচসিএইচআরের তথ্যানুসন্ধান দল। গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

তাজুল ইসলাম বলেন, যেহেতু জাতিসংঘ বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটা সংস্থা, তাদের এই রিপোর্টটা সম্পূর্ণ ইমপার্শিয়াল (নিরপেক্ষ)। কোনো দলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হয়নি। আমাদের সঙ্গেও কথা বলেনি। তারা অপরাধীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলেছেন। যেখানে কথা বলা দরকার, সে জায়গায় কথা বলেছেন। সুতরাং এটা অকাট্য দলিল হিসেবে এ আদালতে ব্যবহার করা যাবে এবং সেটা আমরা ব্যবহার করব বলে আপনাদের জানাচ্ছি।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা বর্ণনা দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বলেন, অস্ত্রের ব্যবহার এবং আহত-নিহতের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, একটা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র একটা জনগোষ্ঠীকে ওয়াইড স্প্রেড এবং সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধের পক্ষে একটা সুস্পষ্ট এবং অসম্ভব জোরালো প্রমাণ। এ প্রমাণটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে একটা অ্যাভিডেন্স (প্রমাণ) হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আসবে।