Image description

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য তৈরি হলেও জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সবাই তৎপর। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো আশা করছে, ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনও সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল বৃহস্পতিবার দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সামিটে যোগ দিয়ে এক অধিবেশনে আবারও বলেছেন, তাঁর সরকার যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজন করবে।

এটা এ বছরের ডিসেম্বরেও হতে পারে। তবে জামায়াতে ইসলামী ডিসেম্বরকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। দলটি বলেছে, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে যদি ডিসেম্বরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে তাতে আমাদের আপত্তি নেই। মাস আমাদের কাছে ফ্যাক্টর না।
 
নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে মাস লাগে সেই মাসের জন্য আমরা প্রস্তুত। এ ছাড়া দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানব না। বাম দলগুলোও আশা করছে, আগামী ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন হবে।

নির্বাচন সামনে রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির নতুন একটি রাজনৈতিক দলও ঘোষণার অপেক্ষায়। এ মাসের শেষ সপ্তাহেই দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আসতে পারে আরো কয়েকটি নতুন দল। সেসব দলের চাহিদা এখনো স্পষ্ট নয়। এরই মধ্যে আগামী রবিবার কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের এই কমিশন নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের চেষ্টা করবে। এ নিয়ে আলোচনা হবে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে। ওই আলোচনার মাধ্যমেই চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ হবে জাতীয় নির্বাচনের পথরেখা। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে কি না সেটিও নির্ধারণ করা হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জন্য সময় রয়েছে আগামী ১৫ আগস্ট পর্যন্ত।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এ নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর গত ১১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে জাতীয় নির্বাচনের আগেও স্থানীয় নির্বাচন করা যেতে পারে। তবে এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় নয়, জাতীয় নির্বাচনেরই প্রস্তুতি নিচ্ছে।

যে বিষয়ে জামায়াতের ভিন্নমত 

নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্বাচন সংশ্লিষ্ট  সংস্কার শেষ করার আগে নির্বাচন না করতে বলেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষেও মত দিয়েছে দলটি।

গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ইসির সঙ্গে  বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে সুন্দর আলোচনা হয়েছে। আমরা লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছি। আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করেছি তারা (নির্বাচন কমিশন) সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। সক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা নিয়েও আলোচনা করেছি। ২৩টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা পরিষ্কার বলেছি, নো ইলেকশন উইদাউট রিফর্ম (সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়)। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রের যেসব অর্গান, বিভাগ জড়িত সেগুলোর সংস্কার করেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। আগের যে তিনটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি, তারই পুনরাবৃত্তি হবে। দেশের দুই হাজার ছাত্র-জনতার জীবন, ৩০ হাজার ছাত্র-জনতার আহত হওয়া, রক্ত ঝরানো বৃথা যাবে। সংস্কার সম্পূর্ণ করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার যেটুকু সংস্কার লাগে তা করতে হবে। আমরা পুরো রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলিনি। নির্বাচন করার জন্য যতটুক  সংস্কার লাগে সেটুকুর জন্য জামায়াতে ইসলাম সময় দিতে প্রস্তুত। আমরা  নির্বাচনের জন্য দিন মাস সময় বেঁধে দিইনি।

ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে পারেএমন সম্ভাবনা সম্পর্কে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে যদি  ডিসেম্বরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে তাতে আমাদের আপত্তি নেই। মাস আমাদের কাছে ফ্যাক্টর না। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে মাস লাগে সেই মাসের জন্য আমরা প্রস্তুত।

ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঐক্য থাকলেও নির্বাচনের সময়, সংস্কার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আপনাদের ভিন্নমত স্পষ্ট হচ্ছেএ প্রশ্নে তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে। ভিন্নমত হচ্ছে বিউটি অব ডেমোক্রেসি।

নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের আছে। প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে।

আপনাদের দলের নিবন্ধন নিয়ে আলোচনা হয়েছি কি নাজানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের নিবন্ধনের বিষয়টি আদালতে পেন্ডিং রয়েছে। আশা করি ন্যায়বিচার পাব, সুবিচার পাব।  দল নিবন্ধন বিষয়ে তিনি আরো বলেন, সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের দল করার অধিকার আছে। নিবন্ধন শর্ত কঠিন করে সেই অধিকার খর্ব করা হয়েছে। সেটা সহজ করার জন্য বলেছি। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের তিন বছর পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিধান আনতে বলেছি। প্রবাসী ভোটারদের ভোট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদে হয়রানি নিরসনের অনুরোধও করেছি। আমরা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চেয়েছি, কালো টাকামুক্ত করে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। আরপিওতে ৯১(এ) সংশোধন করে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল। সেটি পুনর্বহাল করতে বলেছি।

অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, বাংলাদেশ ল ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. জসীম উদ্দীন সরকার, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট এস এম কামাল উদ্দীন, সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী।

বিএনপি যা বলছে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, বৃহৎ পরিসরে সংস্কার করার চেয়ে এখন জাতীয় নির্বাচন হওয়াটা জরুরি। তাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে যতটুকু জরুরি সংস্কার করা দরকার তা করতে হবে। এর বাইরে অন্য সংস্কার চলমান থাকবে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করা যাবে না। এটা নির্বাচিত সরকারের এখতিয়ার। এখন জাতীয় নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচন মানবে না বিএনপি।

বাম দলগুলোর বক্তব্য : কোনো রাজনৈতিক দলের একক সিদ্ধান্তে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হবে না বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এরই মধ্যে সরকার ও নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে একটি ধারণা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে চলতি বছরেই নির্বাচন হচ্ছে বলে আশা করা যায়। তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য প্রয়োজন। এখন সংস্কার কমিশনগুলোর দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স কালের কণ্ঠকে বলেন, সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে এরই মধ্যে আমরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি। তবে দিনক্ষণসহ দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। এরই মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই আগামী ২৫ ডিসেম্বর অতিক্রম করবে না বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

পিআর পদ্ধতিতে সমস্যাও দেখছে সংস্কার কমিশন : এদিকে জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি দল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চাইলেও খোদ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এই পদ্ধতির নির্বাচনে সমস্যাও দেখছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির একটি বড় দুর্বলতা হলোসরকারের সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা। এতে টিরানি অব দ্য স্মল মাইনরিটি বা ছোটদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ ছাড়া সরকার গঠনে ভাঙাগড়ার খেলা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। এমনকি সরকার গঠনে লেনদেনের প্রভাবও ঘটতে পারে। এ ছাড়া সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলের আধিপত্য বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির আরো অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যা অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় উঠে এসেছে। মতবিনিময়ের সময় একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে, অনেক ব্যক্তি ও দল যারা নীতিগতভাবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে, তাদের অনেকেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটির প্রবর্তনের বিপক্ষে। তাদের আশঙ্কা, বর্তমান সময়ে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গৃহীত হলে বিতাড়িত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের আশঙ্কা দেখা দেবে।

সংস্কার কমিশন এ পদ্ধতি বিষয়ে কোনো সুপারিশ না করে প্রতিবেদনে বলেছে, বিষয়টি সম্পর্কে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সম্মানিত রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই যৌক্তিক বলে আমরা মনে করি।