![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/bb4c0050f67034b16871f00d250a59c8.jpg)
জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা এবং নিহতদের লাশ হস্তান্তর ও দাফনে পদে পদে বাধা দেয় নিরাপত্তা বাহিনী। এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসআই, পুলিশের বিশেষ শাখা ডিবি, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ।
বাধা সৃষ্টি করার মধ্যে রয়েছে-আহতদের হাসপাতালে যেতে পথে ও গেটে বাধা প্রদান; ডাক্তারদের হুমকি দিয়ে গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা বন্ধে বাধ্য করা; গুলি নয়, অন্য কারণে মৃত্যু লিখতে বাধ্য করা; ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর; পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর ও দাফনে বাধা এবং চিকিৎসার নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে আহতদের ওপর আরও নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগ। এ সময় তারা হাসপাতালের সিসিটিভির ফুটেজ কেড়ে নেয়।
এর উদ্দেশ্য ছিল-যাতে সহিংসতার প্রমাণ লুকানো যায়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হাসপাতালে ব্যাপক নজরদারি চালায়। আহতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এ ঘটনা রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘন। এছাড়াও এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন।
বুধবার প্রতিষ্ঠানটির জেনেভা কার্যালয় থেকে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এসব ঘটনার বেশ কয়েকটি কেস স্টাডি তুলে ধরে জাতিসংঘ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
হাসপাতালে নজরদারি ও চাপ : পুলিশের বিশেষ শাখা ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) এবং অন্য সংস্থাগুলো হাসপাতালে ব্যাপক নজরদারি চালায়। আহতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে। এমনকি তারা হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ ও চিকিৎসার নথিপত্রও বাজেয়াপ্ত করে।
এর উদ্দেশ্য ছিল সহিংসতার প্রমাণ লুকানো। হাসপাতালগুলোয় চাপ ও ব্যাপক হুমকি দেয় গোয়েন্দা সংস্থা। ডাক্তারদের হুমকি দিয়ে গুলিবিদ্ধ আহতদের চিকিৎসা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয়। চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মীদের হুমকি দেয়-হত্যার প্রকৃত কারণ লিখলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে। একটি হাসপাতালে আহতদের ভর্তি করতে নিষেধ করে পুলিশ।
অপর হাসপাতালে একজন সংসদ-সদস্য আহতদের চিকিৎসা বন্ধ করতে বাধ্য করেন। দুজন চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়। ভয়ে অন্য চিকিৎসকরা গা ঢাকা দেন। ২০ জুলাই থেকে এক হাসপাতালে নতুন কোনো আহত বিক্ষোভকারীকে ভর্তি করতে দেওয়া হয়নি।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল, ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে অনেক স্থানে ঠিকমতো ময়নাতদন্ত হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই করা হয়নি। কিছু হাসপাতালে সরকার থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়-ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। অনেক পরিবার স্বজনের লাশ দাফন করতেও বিলম্ব ও হয়রানির শিকার হয়। কারণ পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টও করেনি, আবার মরদেহ হস্তান্তরেও বাধা দেয়। রিপোর্টে বলা হয়, চিকিৎসাকেন্দ্রের এ ঘটনা রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ধরনের কাজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন।
কেস স্টাডি : ১৮ জুলাই সাভারে পুলিশ কর্মকর্তারা নিরস্ত্র যুবক শেখ আশহাবুল ইয়ামিনকে শটগান দিয়ে কয়েকটি গুলি করে। ওই সময় তিনি একটি নীল রঙের পুলিশ সাঁজোয়া যানের (এপিসি) ওপর উঠেছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জাতিসংঘের তদন্তদলকে জানান, ইয়ামিন রাস্তা পার হয়ে ওই যানটিতে ওঠেন। অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ইয়ামিন এপিসির ছাদে উঠে যানটির হ্যাচ (উপরের ঢাকনা) বন্ধ করার চেষ্টা করেন। প্রতিবেদনে ভিডিও ডকুমেন্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, সাঁজোয়া যানটি দুপুর ১টা ৫৭ মিনিটে সাভারের পুরোনো ওভারব্রিজের নিচে আসে। ২০ মিনিট ধরে সামনে-পেছনে চলে। একাধিকবার টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। ২টা ১৮ মিনিটে ইয়ামিন রাস্তার ব্যারিয়ার পেরিয়ে এপিসির পেছন থেকে ছাদে ওঠেন। তখন লাল শার্ট বুলেটপ্রফ জ্যাকেট পরিহিত এক ব্যক্তি ইয়ামিনের দিকে শটগান দিয়ে গুলি করেন। এরপর চার সেকেন্ডের ব্যবধানে দাঙ্গা প্রতিরোধের পোশাক পরা এক পুলিশ সদস্য তিনটি গুলি করেন। এতে ইয়ামিন এপিসির ওপর পড়ে যান। এরপর সাঁজোয়া যানটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে চলতে থাকে। ইয়ামিন তখনও গুরুতর আহত অবস্থায় ওপরেই পড়েছিলেন। ভিডিওতে একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘তৎক্ষণাৎ হত্যা করো, পিস্তল ব্যবহার করো এবং নিশ্চিত করো যে সে বেঁচে না থাকে।’ তবে গুলি করা হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুরুতর আহত অবস্থায় ইয়ামিনকে চিকিৎসা না দিয়ে পুলিশ এপিসি থেকে নিচে ফেলে দেয়। এতে তার মাথা রাস্তার ওপর আঘাত পায়। এরপর দুই পুলিশ সদস্য ও লাল শার্ট পরিহিত ব্যক্তি তাকে রাস্তার অন্যপাশে টেনে নিয়ে যান। পরে পুলিশ এপিসিসহ চলে যায়। তবে চলে যাওয়ার আগে একজন পুলিশ সদস্য ইয়ামিনের মৃতপ্রায় দেহের ওপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, পুলিশ কর্মকর্তারা উত্তরের দিকে ১৫০ মিটার দূরে থাকা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ধোঁয়া পরিষ্কার হলে ইয়ামিন তখনও শ্বাস নিচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো পুলিশ সদস্য তাকে চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়নি। বিক্ষোভকারীদের একটি দল ইয়ামিনকে দুটি হাসপাতালে নেয়। প্রথম হাসপাতাল থেকে ফেরত পাঠানো হলে দ্বিতীয় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই বেলা পৌনে ৩টায় তিনি মারা যান। ফরেনসিক বিশ্লেষণ নিশ্চিত করেছে, খুব কাছ থেকে করা ধাতব গুলিতে আহত হয়েছিলেন ইয়ামিন। এতে রক্তক্ষরণ হয়ে শরীরে মারাত্মক শক তৈরি হয়। এছাড়া টিয়ার গ্যাসের প্রভাব তার শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দেয়, যা তার মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম দলিল। এ ধরনের ঘটনা একটি নয়। আরও অনেক ডকুমেন্ট আছে জাতিসংঘের কাছে। এসব ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনী আহতদের চিকিৎসায় বাধা দিয়েছে।
কেস স্টাডি ২ : ১৯ জুলাই এক হাসপাতালের সামনে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার গ্যাস ফেলা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ওই হাসপাতালে আহতরা যাতে না যেতে পারে। একই দিন একটি গ্যারেজে আহত বিক্ষোভকারীর চিকিৎসা চলছিল। সেখানে টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে নিরাপত্তা বাহিনী।
কেস স্টাডি ৩ : ৪ আগস্ট ফার্মগেটে ১৭ বছর বয়সি এক কিশোরকে গুলি করে পুলিশ। এরপর তাকে একটি রিকশায় তুলে হাসপাতালে নিতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। এক পুলিশ সদস্য আহত ছেলেটিকে নর্দমায় ফেলে দিতে রিকশাচালককে নির্দেশ দেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে যেতে দেওয়া হলেও অনেক বিলম্ব করানো হয়। আর হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ছেলেটি মারা যায়।
কেস স্টাডি ৪ : ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে আহত বিক্ষোভকারীদের সাহায্যকারী এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করে। এরপর তাকে চারবার গুলি করার হুমকি দেয়। তিনি অনুরোধ করলেও তার পায়ে গুলি চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় নর্দমায় ফেলে রাখা হয়।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ভূমিকা : হাসপাতালের প্রবেশপথে অবস্থান নিয়ে আহতদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করেছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা অ্যাম্বুলেন্স ও ব্যক্তিগত যানবাহন থামিয়ে আহতদের ওপর নির্যাতন চালায়। এমন পরিবেশে অনেক আহত বিক্ষোভকারী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি। কিছু হাসপাতাল পুলিশের হুমকিতে আহতদের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। তবে অনেক চিকিৎসক বিপদের ঝুঁকি নিয়েও বিনামূল্যে আহতদের চিকিৎসা করেছেন।