Image description

রবিউস সানী শিপু। সাভারের আশুলিয়ায় বসবাস। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থী। শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন ছাত্র আন্দোলনে। ৪ঠা আগস্ট ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্বৈরাচার সরকারের পতনের জন্য ছাত্ররা মরণপণ লড়াই করছে। এ অবস্থায় শিপুও অন্যদের মতো আশুলিয়া থানাধীন মসজিদের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেয়। তখন বেলা ১১টা। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। হঠাৎ পুলিশ ছাত্রদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। স্নাইপারের গুলি শিপুর পেটে বিদ্ধ হয়। অঝোরে পড়তে থাকে রক্ত। এই অবস্থাতেও শিপু সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এবার পুলিশ তার পায়ে গুলি করে। তাৎক্ষণিক শিপু লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় শিপুকে নিয়ে যাওয়া হয় আশুলিয়ার একটি ক্লিনিকে। কিন্তু ওই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসা না দিয়ে গেট আটকে দেয়। পরে রিকশাযোগে আরেকটি হাসপাতালে যায় তারা। সেখানেও চিকিৎসক না পেয়ে হতাশ হতে হয় শিপুর পরিবারকে। পরে শিপুকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তিনদিন চিকিৎসা নেয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে শিপু। চিকিৎসক ছুটি দেয়ায় ফিরে যায় নিজ বাসা সাভারে।

গত ১১ই সেপ্টেম্বর ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে আশুলিয়া থানায় মামলা করা হয়। এ মামলাই তার জন্য কাল হয়ে উঠেছে। প্রায় এক মাস চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে থাকার পর বাসা থেকে বের হন। মামলা দায়েরের তিনদিন পর ১৪ই অক্টোবর রাত ৯টার দিকে শিপু শারীরিকভাবে একটু অস্বস্তিবোধ করায় মামাতো ভাইকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। রাস্তায় দেখা হয় বন্ধু আফ্রিদির সঙ্গে। পরে ফারুক নগর ইসমাইল বেপারী হাইস্কুল মাঠে বসে গল্প করতে থাকে। হঠাৎ ওত পেতে থাকা কয়েকজন দুর্বৃত্ত একযোগে শিপুর ওপর আক্রমণ করে। গুলিবিদ্ধ ক্ষত স্থানে কিল, ঘুষি, লাথি মেরে গুরুতর জখম করে। খবর পেয়ে শিপুর মা স্থানীয়দের সহায়তায় শিপুকে উদ্ধার করে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এ ঘটনায় শিপুর মা নাদিয়া আফরোজ শিউলী বাদী হয়ে ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। 

মামলা করে শিপু ও তার পরিবার এখন বিপাকে। প্রতিনিয়ত তাদের হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে শিপুর মা গত ২৩শে ডিসেম্বর এবং ২রা ফেব্রুয়ারি মামলার বাদী শিপুর মা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তার পরিবার ও সাক্ষীর নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য সাতজনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগ দাখিল করেছেন। হুমকিদাতারা হলেন- ১. মো. মেহেদী হাসান হিরু (৪৭), ধামসোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ২. আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবু তাহের। ৩. আশুলিয়া থানা আওয়ামী হকার্স লীগের সদস্য জহিরুল ইসলাম। ৪. আশুলিয়া থানা আওয়ামী হকার্স লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান। ৫. আশুলিয়া থানা ছাত্র লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুল আলীম। ৬. আশুলিয়া থানা ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মো. শান্ত। ৭. আওয়ামী লীগ নেতা মো. রহিম। বিভিন্ন মামলার নথি থেকে জানা যায়, এরা সবাই ডজন খানেক মামলার আসামি। সম্প্রতি এসব আসামিরা বৈষম্যবিরোধী মামলাতেও জামিন পেয়ে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগে বলা হয়, মামলার আসামি বাদীর পরিবারকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ ও অব্যাহতভাবে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এলাকায় কীভাবে বসবাস করে, তা দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসামি মেহেদী হাসান হিরু, লিমা আক্তার ও তার দুই দেবর জহির ও তাহের, হাবিবুর, আলীম, তার ভাই সামাদ, শান্ত, মেহেদী, মো. জিন্নাহ, মো. রহিম, নাসির, মো. মাসুদ হাসান, নাজমুল, দীপু অস্ত্রধারী সদস্য ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এরা নারী ব্যবসা সহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। আশুলিয়া এলাকার বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসীর রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি সহ নানা অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে এসব আসামিদের বিরুদ্ধে। এসব সন্ত্রাসীদের কারণে ‘স্বনির্ভর ধামসোনা ইউনিয়নের’ ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ জনগণ বিভিন্ন সময় নির্যাতিত হয়ে আসছে। সাভার আশুলিয়া থানায় এদের বিরুদ্ধে ১৯টিরও বেশি মামলা রয়েছে। ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসার আড়ালে এলাকায় মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

বিভিন্ন মামলার নথি থেকে জানা যায়, মেহেদী হাসান হিরু আশুলিয়া থানার কুখ্যাত সন্ত্রাসী। সাভার আশুলিয়া সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ডাকাতি ও অস্ত্র আইনে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। ২০১২ সালের ৩রা অক্টোবর আসমা নামে এক গার্মেন্টকর্মীকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শ্রীপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে লাকড়ির দোকানে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে আসামি জহিরের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া একই বছরের ১৪ই জুলাই সুমী আক্তার নামে আরেক নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করেছে। এ ছাড়াও, জহির, তাহের, হাবিবুর, আলীম ও তার ভাই সামাদের বিরুদ্ধে বলপূর্বক অপহরণ করে অন্যায়ভাবে চাঁদা দাবি ও সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালে আব্দুল হাকিম নামে এক ভুক্তভোগী মামলা করেন। মামলার সাক্ষী হওয়ায় লালু মিয়া নামে এক ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীকে গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে রাতের বেলা মাইক্রোবাসযোগে পথরোধ করে কুপিয়ে জখম করে, পায়ে ও হাতে গুলি করে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার অভিযোগে মামলা রয়েছে আসামি জহির, তাহের, হাবিবুর, আলীম, তার ভাই সামাদের বিরুদ্ধে।

এদিকে, গত ৩রা ফেব্রুয়ারি ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তথ্য গোপন এবং জালিয়াতির মাধ্যমে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে। গত ২১শে জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে আসামিরা অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। বাদী পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মো. শাহীন মণ্ডল মানবজমিনকে বলেন, মামলাটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এই মামলায় আদালতে প্রতারণামূলকভাবে মিথ্যা তথ্য দাখিল করে আসামিরা জামিনে বের হয়ে যাওয়া একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। আসামিরা এখন জামিনে বের হয়ে বাদী ও মামলার সাক্ষীদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা জামিনের শর্ত ভঙ্গ করেছে। 

শিপুর মা নাদিয়া আফরোজ শিউলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে জানান, আসামিরা আমাদেরকে অব্যাহতভাবে প্রাণনাশের হুমকি সহ বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি জিডি করা সহ একাধিকবার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেছি।