Image description

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গুম হন ইসলামপুরের কাপড়ের ব্যবসায়ী পারভেজ হোসেন। এরপর আর খোঁজ মেলেনি পারভেজের। অপেক্ষায় থাকে তার পরিবারের সদস্য ও সন্তান। তারপর কেটে যায় দীর্ঘ সময়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বাবাকে ফেরত চেয়ে আর্তনাদ জানায় পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃধি। সে বলেন, ‘২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আমার বাবা গুম হয়। তারপর আর তাকে পাইনি। আমরা সরকারের কাছে কিছু চাই না। শুধু আমার বাবাকে ফেরত চাই। আমি বাবার হাত ধরতে চাই...আর কিছু চাই না। আমরা ১০ বছর ধরে পথে পথে ঘুরছি, আমার বাবাকে পাই না।’

বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে মায়ের ডাক ‘জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ-বিচার প্রক্রিয়া: আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অশ্রুসিক্ত হয়ে এসব কথা বলে হৃধি।

image_123650291 (1)আলোচনা সভায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা

 

হৃধির মতো আরেক ভুক্তভোগী লামিয়া ইসলাম মীম। বাবাকে ফেরত চেয়ে সে বলে, ‘আমার কিচ্ছু লাগবে না। শুধু আমার বাবার হাতটা ধরে হাঁটতে চাই। আমরা শুনেছিলাম, আমার বাবা আয়নাঘরে আছে। কই? আমরা আয়নাঘরে দেখলাম, বাবাকে পেলাম না।’

আলোচনা সভায় নেত্রনিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল বলেন, ‘গতকাল জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাকে আমরা সাধুবাদ জানাতে চাই। তাদের প্রতিবেদনে মূলকথাটা ছিল, জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর সংঘবদ্ধভাবে যে আক্রমণ চালানো হয়েছে, তা যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। তবে জাতিসংঘ বলছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ আরও ভালোভাবে প্রমাণের জন্য অধিক তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। আর এটা প্রমাণ হয়ে গেলে তা আর বাংলাদেশের বিষয় থাকবে না, এটি আন্তর্জাতিক একটি বিষয় হয়ে যাবে। এতে যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচারকাজ কাজের বিষয়টি উঠে আসবে।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের এই তদন্তে যা সহযোগিতা প্রয়োজন, তা সরবরাহ করুক। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের যারা তদন্তকারী আছেন, তাদের সদিচ্ছার কোনও অভাব নেই। কিন্তু ক্যাপাসিটির একটি গুরুতর ঘাটতি রয়েছে, কারণ ফরেনসিক আর্কিটেকচার নিয়ে আমাদের কোনও স্পেশালিস্ট নেই। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তা আমরা চাইতেই পারি। এখানে জাতিসংঘ আমাদের সহযোগিতা করতে পারে এবং সরকারের পক্ষ থেকেই উচিত এই প্রস্তাবটা দেওয়া।’

image_123650291 (2)আলোচনা সভায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা

তাসনিম খলিল আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তিরা বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, সে টাকা উদ্ধারেও সরকারের উচিত জাতিসংঘের সহায়তা নেওয়া। এছাড়া আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা মানবাধিকার সংগঠনগুলো একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জনগণের কাছ থেকে একটি দাবি আসা। জনগণ বা ভুক্তভোগী পরিবাররা যদি মনে করে, সার্বিক বিষয়ে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হোক, তাহলে বর্তমান সরকার সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেলিন বলেন, ‘বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ শুধু জুলাই-আগস্ট মাসে হয়নি। যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত আছেন, আমাদের ছাত্র বন্ধুরা, তারা এতদিন ধরে শুধু শহীদ শহীদ বলে আসছেন। শহীদ এবং অপারেশন ডেভিল হান্ট এগুলো সব আধ্যাত্মিক ও ধর্মতাত্ত্বিক শব্দ। এই সব শব্দ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’ এ সময় তিনি ডিজিএফআই নামে সংগঠনের বিলুপ্তির প্রতিও অভিমত জানান।

এ সময় গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা বলেন, পৃথিবীতে মানবতাবিরোধী সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো গুম। কারণ গুম করা হলে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির কোনও চিহ্নই থাকে না। পরিবারের কাছে কেবল তার স্মৃতিটুকুই থাকে। তার আর কোনও অস্তিত্ব থাকে না। যারা ফিরে আসেনি, বন্দি ছিল, তারা হয়তো আর্তনাদ করে বলেছে আমাকে ছেড়ে দেন, আমি আর কিছুই করবো না, রাজনীতি করবো না। আমার ঘরে ছোট সন্তান আছে, বৃদ্ধ বাবা-মা আছে, আমাকে ছেড়ে দেন। কিন্তু ঘাতকদের কানে সেই আর্তনাদ পৌঁছায় না। যারা এই গুমের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে আমরা তাদের সুষ্ঠু বিচার চাই।

সংবাদ সম্মেলনে মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলামসহ ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।