![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/24f1670f74e4a4d7ba74850e622f43a4.webp)
প্রত্যাশার পারদ ছিল তুঙ্গে। ব্যাপক সংস্কারের অঙ্গীকার ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। বিশেষত বাংলাদেশের বিদেশনীতি বাস্তবায়নের ফোকাল পয়েন্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি ছিল রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের ফসল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন আপৎকালীন সরকারের। কিন্তু ৬ মাসে সংস্কার-পরিবর্তন দূরে থাক বরং এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে সেগুনবাগিচায়। জেঁকে বসা সেই স্থিতাবস্থায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের ডিপ্লোমেসি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফরেন পলিসির বড় অংশ জুড়ে থাকা বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন এবং কোথায় যাচ্ছে তার কোনো নির্দেশনা নেই। বন্ধুপ্রতিম যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। বহুপক্ষীয় ডিপ্লোমেসির আঁতুড়ঘর নিউ ইয়র্ক, জেনেভা, ব্রাসেলসে বাংলাদেশ আছে কি নেই তা টের পাচ্ছেন না খোদ পেশাদাররা। নিউ ইর্য়কস্থ বাংলাদেশ মিশন আলোচনায় আসে নতুন দূত নিয়োগের প্রক্রিয়ায়। বহুপক্ষীয় কূটনীতির অভিজ্ঞতা নেই এমন একজনকে স্থায়ী প্রতিনিধি করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকেনি। জেনেভা হেডলাইন হয় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে বিমানবন্দরে হেনস্তার ঘটনায়। স্থায়ী মিশনের দু’জনের ইন্ধনে সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ ড. আসিফ নজরুলকে ঘিরে ধরে। তাৎক্ষণিক তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মিশনের দু’জনের নাম আসার পর তাদের একজনকে দ্রুত ঢাকায় ফেরত এবং অন্যজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ব্রাসেলসের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিশনে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রদূতের পদটি খালি। ছ’মাসে হেডকোয়ার্টার এবং মিশনগুলোতে পরিবর্তন আনতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করেছে মিস্টার হোসেনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অনেককে ফেরত আনা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র সচিবের ন্যূনতম কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। যদিও তিনি ছাত্র-জনতার ঝরানো রক্তের সিঁড়ি বেয়েই সচিব পদে আসীন হয়েছেন।
এটা সবার জানা, পতিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল। সেই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের তিক্ত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় সচিব উপদেষ্টার সঙ্গে ‘সহমত’কেই শ্রেয় মনে করছেন। এ বিষয়ে উভয়ের ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এখন কবরের শান্তি বিরাজমান। বক্তৃতা-বিবৃতি তথা মিডিয়ায় উপদেষ্টা, সচিব আর মুখপাত্রের উপর্যুপরি ব্রিফিংয়ের বাইরে থেকে মনে হতে পারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন সক্রিয়।
বাস্তবে ঠিক উল্টো। কতিপয় ঘটনা, দুর্ঘটনা নিয়ে সরব থাকার চেষ্টা ছাড়া ফরেন পলিসিতে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেই। অভ্যন্তরীণ বদলি-পদোন্নতি নিয়ে পেশাদারদের মাঝে অন্তহীন ক্ষোভ বিরাজমান। অভিযোগ উঠছে রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, মিশন প্রধান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নে পতিত সরকারের পদাঙ্কই অনুসরণ করছে বর্তমান সরকার। ফলে হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীরাই ঘুরে ফিরে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন কিংবা বহাল রয়েছেন। প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে উপদেষ্টা আর নতুন পররাষ্ট্র সচিব নিয়োগ ছাড়া সেগুনবাগিচায় কার্যত কোনো পরিবর্তন নেই। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, মিশন প্রধান বা উপ-প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাদের নিয়োগ অনুমোদন করে গেছেন অন্তর্বর্তী সরকারে তার সিকি পরিমাণ পরিবর্তন করেনি। এমনকি বিষয়টি রিভিউ করারও প্রয়োজন মনে করেনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, হাসিনা আমলে মিশনগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে। দুর্নীতি, নারী নির্যাতন আর বঞ্চনার কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। মোমেন-শাহরিয়ার জমানায় সাইবারের মতো স্পর্শকাতর কমিউনিকেশন লিক হয়েছে, যা দেশের জাতীয় নিরাপত্তায় দীর্ঘ মেয়াদে হুমকি তৈরি করেছে। কিন্তু ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন প্রভাবশালীরা এতে অনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। ফলে তদন্ত ফাইল পর্যন্ত গায়েব করে দেয়া হয়। উপদেষ্টা হওয়ার আগে থেকেই তৌহিদ হোসেন এসব ঘটনার বিষয়ে অবহিত। এক সময় তিনি নিজেও এসবের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। উপদেষ্টার চেয়ারে আসীন হওয়ার পর তিনি নতুন করে সব জেনেছেন। তাকে ব্রিফ করেছেন কর্মকর্তারা। মিশনগুলোতে চুরি, দুর্নীতি তথা পেশাদারদের অপেশাদারি আচরণের সবক’টি ঘটনা তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে অভ্যুত্থানে যুক্ত ছাত্র-জনতাকে ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘জঙ্গি’ বলে দুনিয়াতে প্রচার করা কূটনীতিকদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি ছিল তার। কিন্তু না, ৬ মাসে তিনি হয় তার আগের অঙ্গীকার ভুলে গেছেন কিংবা অপরাধীদের নীরবে ‘ক্ষমা’ করে দেয়ার নীতি নিয়েছেন! হাসিনা আমলে সংঘটিত কোনো অপরাধের বিচার তো দূরের কথা, একটি ঘটনার তদন্ত ফাইলও খুলতে পারেননি তিনি। বরং ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে এবং শেখ হাসিনা সরকারকে রক্ষায় পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে ‘অ্যাক্টিভিস্ট’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া কিছু কর্মকর্তাকে নানাভাবে পুরস্কৃত করেছেন উপদেষ্টা মিস্টার হোসেন।
ছয় মাসের তৎপরতা এবং:
শুরুর দিনগুলোতে অনেকটা হানিমুন মুডেই কাটিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। একান্ত ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক সফরে কিছু সময় কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহ গেছে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের প্রস্তুতিতে। ওই অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন প্রধান উপদেষ্টা। পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও ব্যস্ত সময় কাটান নিউ ইয়র্কে। অধিবেশনের সাইড লাইনে একটি বৈঠক ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সেটি হলো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক। খবরে প্রকাশ, ওই বৈঠকে মোটাদাগে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আলোচনা এবং সম্পর্ক এগিয়ে নিতে উভয়ের মধ্যে ঐকমত্য হয়। উপদেষ্টার ৬ মাসে ৬টি সফর করেছেন। যার ৫টিই বহুপক্ষীয় কর্মসূচি উপলক্ষে। নিউ ইয়র্কের পর ক্যামেরুন, সামওয়া, কুয়েত, পর্তুগাল সফর করেন তিনি। অবশ্য গত ২০ থেকে ২৪শে জানুয়ারি ছিল তার চীনে দ্বিপক্ষীয় সফর। সেই সফরে চিকিৎসার জন্য ভারতের বিকল্প হিসেবে চীনকে গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে। দেশে চীনের হাসপাতাল নির্মাণে পূর্বাচলে জায়গা দিতে সম্মত হয় সরকার। কলকাতার বিপরীতে ‘কুনমিংকে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা বিশেষত: ২/৩টি হাসপাতাল সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয় উভয় পক্ষ। সে ক্ষেত্রে ভিসাসহ অন্যান্য বিষয় সহজ করার তাগিদ দেয়া হয় ঢাকার তরফে।
সেই আলোচনায় তিস্তা এমওইউ নবায়নে আরও নতুন দু’টি পয়েন্ট যুক্ত করার বিষয়ে সম্মত হয় দুই পক্ষ। তাছাড়া চীনা ঋণের সুদহার ৩ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং পরিশোধের সময়সীমা ২০ থেকে ৩০ বছর করার বাংলাদেশি অনুরোধকে বেইজিং ইতিবাচকভাবে বিবেচনায় নিয়েছে। বৈঠকে সরকারের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি ব্যবসা, বাণিজ্য ও অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা করেন উপদেষ্টা। তিনি ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানান।
বারবার সিদ্ধান্ত বদল: আগের সরকারের আমলে মনোনয়ন পাওয়া কোনো রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারের মনোনয়ন পরিবর্তন করেননি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তবে তার আমলে যে ক’জন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ হয়েছে তার মধ্যে অন্তত দু’জনের মনোনয়ন পরিবর্তন হয়েছে। একটি মস্কো, অন্যটি বাগদাদ। এক মাসের ব্যবধানে দু’টি স্টেশনে ৪ জন রাষ্ট্রদূতের নাম প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের দুর্বলতা তথা ‘ইনকনসিসটেন্সি’ প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করেন পেশাদাররা। তবে ওয়ারশতে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রদূতের এগ্রিমো আসার পরও ছাত্র-আন্দোলনে বিরোধিতার অভিযোগে আচমকা নিয়োগটি বাতিল হওয়ার বিষয়টি সরকারকে বিপাকে ফেলে। এসব স্পর্শকাতর নিয়োগের বিষয়টি আরও যাচাই-বাছাইপূর্বক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ।