Image description

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে রোগে মৃত্যুর প্রথম কারণ হৃদ্‌রোগ। এর অন্যতম প্রধান চিকিৎসা করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট (সিএবিজি), যা বাইপাস সার্জারি নামে সাধারণের কাছে পরিচিত। দেশে এই অস্ত্রোপচার শুরু হয় চার দশকের বেশি আগে। এ সময়ে হৃদ্‌যন্ত্রের চিকিৎসা কেন্দ্র এবং শল্যচিকিৎসকের (সার্জন) সংখ্যা বাড়লেও বাইপাস সার্জারিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা পারফিউশনিস্টের অভাব রয়ে গেছে। ফলে দেশে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও রোগীদের শল্যচিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় পূর্ণতা আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

পারফিউশনিস্টের কাজ অস্ত্রোপচারের সময় হৃদ্‌রোগীর হৃদ্‌যন্ত্র ও ফুসফুসের কার্যকারিতা বজায় রাখায় ব্যবহৃত হার্ট-লাং মেশিন পরিচালনা করা। অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর হৃদ্‌যন্ত্রের কাজ কৃত্রিমভাবে বন্ধ রাখা হয়। এ সময় হার্ট-লাং মেশিন সারা শরীরে রক্ত পাম্প ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। হৃৎপিণ্ড বন্ধ করা থেকে শুরু করে আবার চালু করা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের দায়িত্ব পারফিউশনিস্টের।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল পারফিউশনিস্টের (বিএসসিপি) তথ্য বলছে, ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার এই দেশে পারফিউশনিস্ট রয়েছেন মাত্র ৮০ জন। কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয় এমন কোনো কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে দুই বা তিনজন রয়েছেন। আবার কোনো কেন্দ্রে নেই একজনও। মোট পারফিউশনিস্টদের ৯০ শতাংশই কাজ করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

দেশে রক্তনালি ও হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার প্রধান বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) এখন পারফিউশনিস্ট রয়েছেন মাত্র একজন। সেখানে পারফিউশনিস্টের পদ রয়েছে ৬টি। টেকনিশিয়ানরাই পারফিউশনিস্টের কাজ করলেও পদগুলো চিকিৎসকদের।

২০০৪ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর এনআইসিভিডিতে পারফিউশনিস্টের কাজ করা ডা. মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বর্তমানে ভাসকুলার সার্জারি বিভাগে যুক্ত। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হৃদ্‌যন্ত্রের অস্ত্রোপচারে পারফিউশনিস্টের গুরুত্ব একজন সার্জনের তুলনায় কম নয়। তাঁর একটু ভুলের কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বাইপাস সার্জারির সময় পারফিউশনিস্ট হার্ট-লাং মেশিনের মাধ্যমে শরীরের সর্বত্র রক্ত ও অক্সিজেনের সঞ্চালন করেন। মস্তিষ্কে মাত্র চার মিনিট এবং কিডনিতে আধা ঘণ্টার মতো রক্তসঞ্চালন বন্ধ থাকলে এ দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিকল হয়ে যাবে। মস্তিষ্ক বা এ রকম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিকল হলে তো রোগী বাঁচবে না।’

জ্যেষ্ঠ কার্ডিয়াক সার্জনরা বলছেন, দেশে পারফিউশনিস্টের অভাবের মূল কারণ হচ্ছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকা। পারফিউশনিস্টের কাজ করার জন্য চিকিৎসক হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়। টেকনিশিয়ানরাই মূলত এ কাজ করেন। তবে বাংলাদেশে শুরু থেকেই পদটি চিকিৎসকদের জন্য তৈরি। এ পদগুলোতে পদোন্নতির সুযোগ নেই। অন্যদিকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চিকিৎসকদের পদোন্নতির মৌলিক শর্ত। পারফিউশনিস্ট হিসেবে যোগ দেওয়ার পরে চিকিৎসকেরা আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন না। পদোন্নতি না পাওয়ার কারণে অনেকে এ কাজ করতে আগ্রহ বোধ করেন না।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসকদের পারফিউশনিস্টের কাজ করতে হয় না। বিএসসিপির তথ্য অনুযায়ী, এ দেশেও পারফিউশনিস্টদের সিংহভাগই টেকনিশিয়ান। কেউ সার্জনদের সঙ্গে কাজ করতে করতে শিখেছেন বা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাংলাদেশে এর জন্য তেমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না। মাত্র সম্প্রতি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন চার বছরের একটি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছে।

ভারত থেকে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পারফিউশনিস্টের কাজ করছেন বিএসসিপির সহসভাপতি মো. এনামুল হক। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কাজটিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। পর্যাপ্ত ট্রেনিং ও ডিপ্লোমার ব্যবস্থা নেই। অন্যান্য দেশে গ্র্যাজুয়েশনের পর এ নিয়ে তিন-চার বছরের কোর্স করতে হয়। এরপর সার্জন ও পারফিউশনিস্টের অধীনে এক শ বা দুই শ সার্জারিতে অংশ নেওয়ার পর স্বীকৃতি পাওয়া যায়।’

হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে বর্তমানে রোগে মৃত্যুর ৭০ শতাংশ হচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধির কারণে। মোট মৃত্যুর ৩৪ শতাংশই হচ্ছে হৃদ্‌রোগে। কিন্তু এর চিকিৎসায় রয়ে গেছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (এনআইএইচ) ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বাংলাদেশে হৃদ্‌যন্ত্রের অস্ত্রোপচারের ৪ দশক নিয়ে এক গবেষণার ফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ১৯৮১ সালে সূচনার পর কার্ডিয়াক সার্জারি ও চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় ১৩ হাজার। এসব অস্ত্রোপচারের মধ্যে বাইপাস ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ হৃদ্‌যন্ত্রের চিকিৎসার একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে পারফিউশনিস্টের প্রয়োজন হয়।

ঢাকার বাইরে সরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১২ সালে প্রথম কার্ডিয়াক সার্জারি শুরু করেন অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন। তিনি বর্তমানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। ডা. নাজমুল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশে ডক্টর পারফিউশনিস্ট ও নন-ডক্টর পারফিউশনিস্ট রয়েছেন। হার্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে সম্প্রতি কোর্স শুরু করেছে। চট্টগ্রামে সার্জারি শুরু হওয়ার পরে তিনটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১২ জন নার্সকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। পারফিউশনিস্ট তৈরির জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে উদ্যোগ নেব।’

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের কোর্স শেষ করে এ পর্যন্ত মোট ৩ জন পারফিউশনিস্ট বের হয়েছেন। গত বছরের অক্টোবরে ৫ জন ভর্তি হয়েছেন এই কোর্সে। বর্তমানে চলছে চারটি ব্যাচ।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক অ্যানেসথেসিওলজিস্টের (বিএসিএটিএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ টি এম খলিলুর রহমান আজকের পত্রিকাকে জানান, দেশে পারফিউশনিস্টদের মধ্যে ৬ জন বিদেশ থেকে ডিপ্লোমা করেছেন। ১৫ জন হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে দুই বছরের সার্টিফিকেট প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং ৩ জন ডিপ্লোমা করে বের হয়েছেন। আর বাকিরা সার্জনদের সঙ্গে কাজ করে শিখেছেন।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশে দুটি কারণে পারফিউশনিস্টের অভাব। একটি হচ্ছে চিকিৎসক পারফিউশনিস্টের পদগুলো ‘ব্লক পোস্ট’। অর্থাৎ কোনো চিকিৎসক পারফিউশনিস্ট হলে তাঁর পদোন্নতির সুযোগ থাকে না। এনআইসিভিডিতে দক্ষ টেকনিশিয়ান রয়েছেন, যাঁরা পারফিউশনিস্টের কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করেন। কিন্তু তাঁদেরকে এখানে পারফিউশনিস্টের পদ দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, শুরুতেই পদটি ডাক্তারদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে টেকনিশিয়ানদের পারফিউশনিস্ট হিসেবে তৈরি করার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক কোর্সই এত দিন ছিল না।’