![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/4a4d13f24a7901dc5ba78acd331a3ca3.webp)
ছোট ছোট খুপরি। গা ছমছম পরিবেশ। আলোহীন এক একটি কামরা যেন গ্রামের মুরগির খাঁচা। বাইরের জগৎ থেকে পুরাই আলাদা। কোথায় আছেন, দিনের কোন সময় পার করছেন জানারও সুযোগ নেই। কোনো কোনো কক্ষ সাউন্ডপ্রুফ। যেসব কক্ষে থাকতো নির্যাতনের নানা সরঞ্জাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ভিন্নমত দমনে গড়ে ওঠে এসব সেল। যেটি আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা নামে পরিচিত। বছরের পর বছর আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে অনেক নিরপরাধ মানুষ। এখান থেকে কেউ কেউ ফিরে এসেছেন, কেউ ফেরেননি। মৃত্যুই যাদের শেষ ঠিকানা হয়েছে। সরকারের নির্দেশে গুম করা অনেক মানুষকে এখানে বন্দি রাখতো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বন্দিজীবনের গল্প ফুটে উঠেছে আয়নাঘরের দেয়ালে দেয়ালে। কিন্তু সেই আয়নাঘরের অনেক আলামতই গায়েব হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল পরিদর্শন করেছেন রাজধানীতে থাকা তিন আয়নাঘর। যেগুলো বিগত সরকারের গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত ছিল। কচুক্ষেত, আগারগাঁও ও উত্তরায় অবস্থিত এসব আয়নাঘরের একটি ডিজিএফআই’র, বাকি দুটো র্যাবের। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- গুমের শিকার হওয়া একাধিক ব্যক্তি ও গুম কমিশনের সদস্যরা। কিন্তু এ পরিদর্শনের সময় নিজেদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি সরকার। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকে আয়নাঘর পরিদর্শনের সুযোগ দেয়ার কথা থাকলেও প্রধান উপদেষ্টার পরিদর্শনের সময় সেটি করা হয়নি। কেবল পছন্দমতো দুইটি গণমাধ্যমকে (আলজাজিরা ও নেত্র নিউজ) এ সুযোগ দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া একজন সংবাদকর্মী প্রধান উপদেষ্টার পরিদর্শনের সময় সঙ্গে ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো ভিডিও ও স্থির চিত্রে দেখা যায়, আয়নাঘরের অন্দরের চিত্র। এক একটি ফুটেজ যেন কালের সাক্ষী, বীভৎস ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। তবে আয়নাঘরের চিত্র সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠছে এর আলামত ধ্বংসের বিষয়টি। অসংখ্য গোপন কক্ষের দেয়াল ভেঙে কক্ষগুলোকে বড় করে দেখানো হয়েছে। পলেস্তারা ও রং করা হয়েছে একাধিক কক্ষের দেয়ালে। যার কারণে মুছে গেছে দেয়ালে খোদাই করা ও আঁকা বন্দিদের নানা কথা, গল্প। এ ছাড়াও টর্চার সেলের বিভিন্ন সরঞ্জামও গায়েব করা হয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলোও অকেজো করে ফেলা হয়েছে। যেসব সরঞ্জামের মাধ্যমে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো। আয়নাঘরে ছিল নির্যাতনের বিভিন্ন সরঞ্জাম। এরমধ্যে ইলেকট্রিক চেয়ার, উচ্চ শব্দ করার যন্ত্র ও বিভিন্ন ইলেকট্রিক সরঞ্জাম। কোনো কোনো কক্ষ ছিল সম্পূর্ণ সাউন্ডপ্রুফ। গোপন বন্দিশালার দেয়ালে বন্দিদের আঁকা বিভিন্ন লেখার মধ্যে ছিল- ‘আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি’, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’ এদিকে বন্দিশালাগুলো সিসি ক্যামেরা দ্বারা নজরদারি করা হতো। আজ সেসব সিসি ক্যামেরার কিছু কিছু দেখা গেলেও এসব ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে অসংখ্য কক্ষের দেয়াল। যেগুলোতে ফুটে উঠেছিল গুম হওয়া মানুষের নরকযন্ত্রণার দিনগুলোর গল্প। সেগুলোর বেশির ভাগই আজ পলেস্তার করা। যেগুলো হতো পারতো তদন্ত কমিটির কাছে এক একটি ডকুমেন্ট। প্রশ্ন উঠছে এসব আলামত ধ্বংস করা হলো কেন? কারা এসব ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছেন। আলামত ধ্বংসের জবাব কি পাওয়া যাবে? সরকারের গঠিত গুম কমিশনও বলছে অনেক আলামত ধ্বংস করা হয়েছে। কমিশনের সভাপতি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী অক্টোবরে বলেছেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স তারা নষ্ট করে দিয়েছে ওয়ালে পেইন্ট করে। ভিক্টিমরা বলেছিল ওয়ালে তাদের অনেক কথা, নাম এগুলো লেখা ছিল। অনেকের ফোন নম্বর, অনেকের ঠিকানা লেখা ছিল। ওই জিনিসগুলো পেইন্ট হওয়ার কারণে সেটা আর আমরা ওখানে পাইনি। গত ৫ই আগস্ট যখন রেজিম চেইঞ্জ হলো, তার পরপরই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের ধারণা।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে আলামত ধ্বংসের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আলামত ধ্বংস হয়েছে কিনা সেটি গুম কমিশন বলতে পারবে। তারা দেখছেন বিষয়টি। সে অনুযায়ী যে মামলাগুলো হয়েছে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা দেখছেন। সরকার প্রত্যেক বিষয় দেখছে। আলামত হিসেবে সবগুলো আয়নাঘর সিলগালা থাকবে। যেটি আইনি প্রক্রিয়ায় আমাদের লাগবে। আলামত ধ্বংস করা হয়েছে- আপনারা মনে করেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মনে হওয়াটা আইনি বিষয়। তারা বলবেন, আলামত ধ্বংস হয়েছে কিনা, বা কীভাবে হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আমরা পলেস্তারা দেখেছি। কোনো কোনো জায়গায় কক্ষগুলো ছোট ছিল সেখানে দেয়াল ভেঙে বড় করা হয়েছে। যেটি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত গুম কমিশন দেখবে। তিনি বলেন, দেশের কোথায় কোথায় আয়নাঘর ছিল, কারা এর সঙ্গে জড়িত- প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হবে।
আয়নাঘরে যা দেখা গেল
খুট খুটে অন্ধকার। খুপড়ি ঘর। দেখতে খুবই ছোট। অধিকাংশই তিন ফুট বাই চার ফুটের মধ্যে। যেখানে একজন বন্দির নিজের মতো করে করার কিছুই নেই। ওপরে এগজস্ট ফ্যান বা ভেন্টিলেটর জাতীয় ফ্যান লাগানো। কোনো কোনো কক্ষে দু’টি। যেখান থেকে শ্বাস নেয়ার মতো বাতাস, কিছুটা আলোও আসতো। কিন্তু এমন কক্ষের মধ্যেই বন্দির প্রস্রাব-পায়খানার জায়গা। এরমধ্যেই দিনের পর দিন আটক রাখা হতো আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদের। কোনো কোনো কক্ষে শুধু ছোট একটা হোলের (ছিদ্র) মতো। যেটা আবার বেশির ভাগ সময়েই লাগিয়ে রাখা হয়। বন্দি ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, ওখানেই বন্দিকে প্রস্রাব-পায়খানা, গোসল করতে হতো। জায়গাটা সর্বোচ্চ সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট। বছরের পর বছর, মাসের পর মাস এভাবে রাখা হতো তাদের। সারাক্ষণ এগজস্ট ফ্যান চলতো খুপড়ি ঘরগুলোতে, ফ্যান বন্ধ হলেই কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যেতো। কেউ কাউকে দেখার বা কথা বলার সুযোগ নাই। হাতে হ্যান্ডকাপ ও চোখ মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। শুধু খাবার ও বাথরুমে যাওয়ার সময় এসব খুলে দেয়া হতো। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমকে নিয়ে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা টর্চার সেল বা আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে এমন চিত্র দেখতে পেয়েছেন। আয়নাঘরের বীভৎস দৃশ্য দেখে প্রধান উপদেষ্টাও বিস্মিত হয়েছেন। বলেছেন, আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়্যামে জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা (গোপন কারাগার) তার একটি নমুনা। প্রধান উপদেষ্টার অনুভূতি ব্যক্তের চেয়েও যেন ভয়াবহ চিত্র গোপন কারাগারগুলোতে, যা অধিক পরিচিতি পেয়েছে আয়নাঘর নামেই। দিনের পর দিন একেকজন বন্দি গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখে বা তার সংকেত লিখে যায়, কীভাবে দিন গণনা করে, তার ধারণা মেলে গোপন কারাগারগুলোতে। বুধবার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-১, র্যাব-২ ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বাহিনী (ডিজিএফআই) এর প্রধান কার্যালয় কচুক্ষেতে গিয়ে তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ভুক্তভোগীদের কথা শুনেন। পরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও আয়নাঘর পরিদর্শনে ছিলেন বর্তমান তথ্য ও সমপ্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ ভুক্তভোগী ও সাংবাদিকরা।
আগারগাঁও র্যাব-২ এর আয়নাঘরের দায়িত্বে ছিল ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি)। সেখানে একটি চেয়ার দেখে যেন থমকে যান সবাই। সেই চেয়ারে বসিয়ে ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেকট্রিক শক দেয়ার বর্ণনা শোনেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্যান্য উপদেষ্টা, ভুক্তভোগী ও দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা। র্যাব-২ এর আয়নাঘর পরিদর্শনে দেখা যায়, একটি স্টিলের চেয়ার। যেখানে ইলেট্রিক শকের সব ধরনের ব্যবস্থা। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা মতে, নির্যাতনের জন্যেই এই চেয়ার ব্যবহার করা হতো। বেশির ভাগ সময়েই ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেক্ট্রিক শক দিতে ব্যবহার হতো এই চেয়ার। ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) ছিল এই আয়নাঘরের দায়িত্বে।
পরিদর্শনে নিজেদের বন্দি জীবনের বীভৎসতার কথাও মনে পড়েছে দুই উপদেষ্টা নাহিদ ও আসিফের। তাদেরকেও ৫ই আগস্টের আগে ওই গোপন বন্দিশালায় বন্দি রাখা হয়েছিল। তারা গোপন বন্দিশালার কোনো কক্ষে ছিলেন, নিজেরাই শনাক্ত করেছেন। জুলাই মাসে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়েছিল তাদের। এরপর টর্চার সেলে (নির্যাতন কেন্দ্র) রাখা হয়। প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি আজ তার ফেসবুকে দেওয়া পৃথক পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল বুধবার রাজধানীর তিনটি এলাকায় গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন, যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত। সুচিস্মিতা তিথি ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে একটি কক্ষের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। একটি ছবিতে নাহিদ ইসলাম রয়েছেন। সুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআই’র এই টর্চার সেলে রাখা হয়েছিল নাহিদ ইসলামকে। সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি শনাক্ত করেন নাহিদ। এই কক্ষের একপাশে টয়লেট হিসেবে একটি বেসিনের মতো ছিল বলে জানান তিনি। ৫ই আগস্টের পর এই সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রং করা হয়। সুচিস্মিতা তিথি ফেসবুকে আরেকটি পোস্টে অপর একটি কক্ষের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। একটি ছবিতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রয়েছেন। সুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআই’র এই টর্চারসেলে রাখা হয়েছিল আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে। পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি চিনতে পেরেছেন তিনি। দেয়ালের ওপরের অংশের খোপগুলোতে এগজস্ট ফ্যান ছিল বলে জানান তিনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসে ইন্টারোগেশন করা হয়েছে অনেক। যখন চোখ খোলা হয়েছিল, তখন এ রকম একটা রুম দেখেছি। যতক্ষণ রুমে থাকতাম, ততক্ষণ চোখ খোলা থাকতো, হাতকড়া খুলে দিতো। রুম থেকে বের করার সময় চোখ বাঁধতো, হাতকড়া বাঁধতো। এখানে ছিল একটা কাঠের দরজা, তার সামনে একটা লোহার দরজা ছিল। দরজার নিচ দিয়ে খাবার দিত। রুমে গোল গোল হলুদ লাইট ছিল। প্রচুর সাউন্ড হতো বাইরে। একটা পটের মতো ছিল, প্রস্রাব করতে হলে এখানেই করতে হতো। আদার্স লাগলে তারা ওয়াশরুমে নিয়ে যেত। কাঠের দরজা এবং সামনে বা পেছনে লোহার দরজা ছিল। নাহিদ আরও জানান, ওই কক্ষের একপাশে টয়লেট হিসেবে একটি বেসিনের মতো ছিল। ৫ই আগস্টের পর এই সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রঙ করা হয়।
ভুক্তভোগী প্রকৌশলী মাশরুর আনোয়ার চৌধুরী প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ২০২০ সালে আমি ইন্টারকন্টিনেন্টালের প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করি। আমার নিজের ফেসবুক আইডিতে লেখালেখি করতাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসার প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে দুই লাইন লিখেছিলাম। পরেরদিন হাতিরঝিল এলাকা থেকে অফিসে আসার সময় আমাকে মাইক্রোবাসে করে তুলে আনে। আমাকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ র্যাব-১১ এর গুম সেলে নিয়ে রাখা হয়। পরদিন আমাকে ঢাকার এই জায়গায় আনা হয়। তারপর লুঙ্গি ও টি-শার্ট পরিয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকতে বলে। আমি তখন চেষ্টা করছিলাম বুঝার জন্য কোথায় আছি। আমার সাত মাস ও দেড় বছরের দু’টি বাচ্চার কথা চিন্তা করছিলাম। আমি শিওর ছিলাম আমাকে মেরে ফেলা হবে। তখন আমার আশপাশে যাদেরকে আগে এনে রাখা হয়েছিল তারা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। চিন্তা যেন না করি। এখানে আল্লাহ্ আমাদেরকে দেখবেন। তখন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের কেউ এক বছর, দেড় বছর, দুই বছর ধরে আয়নাঘরে ছিল। কারও সঙ্গে কথা বলা যেত না। আমাদের যোগাযোগটা ইশারায় হতো। যারা গুম করেছিল তারা আমাদের বলেছিল কেউ যেন কারও সঙ্গে কথা না বলি। তারা যখন আসতো তখন আমরা চুপ করে শুয়ে পড়তাম। পাশের রুমে একজন ছিল তাকে খুব বেশি মারধর করা হতো। সে যতক্ষন না কান্না না থামাতো ততক্ষণ তাকে মারধর করা হতো। জানতে পারি তাকে মারতে মারতে পাগল বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ন্যাংটা দাঁড়িয়ে থাকতো। এভাবেই ১০দিন আমাকে আটকে রাখা হয়। পরে একদিন আমাকে ডেকে নেয়া হয়। আমি সেদিন ধরেই নিয়েছিলাম আমাকে মেরে ফেলা হবে। আমি তখন কালেমা ও দোয়া পড়ি। আমাকে গুম করার সময় আরও দুইজন প্রকৌশলীকে গুম করা হয়। তারা দু’জন শুধুমাত্র আমার সঙ্গে চলতো, চা খেত এজন্য গুম করা হয়। আমাদের যেদিন মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখিয়ে মিডিয়ার সামনে নেয়া হবে তার আগেরদিন আমাদেরকে নারায়ণগঞ্জে একটি হোটেলের সামনে নেয়া হয়। আমাদের সঙ্গে একজন হুজুর ছিলেন। তাকেও দুই সপ্তাহ আগে গুম করে র্যাব-১১ এর গুম সেলে রাখা হয়। পরেরদিন আমাদেরকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয়। আমাদের নাকি নাশকতার পরিকল্পনার সময় হাতেনাতে ধরা হয়। তখন আমরা ৬ ডিজিটের বেতনের চাকরি চলে যায়। সেই থেকে আমি অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ি। এখনও আমাকে হাজিরা দিতে হয় আদালতে।
আয়নাঘর নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লেখেন, এ রকমই কোনো একটা ঘরে হয়তো আমার বাল্যবন্ধু সাজেদুল ইসলাম সুমনকে আটকে রাখা হয়েছিল। এইরকমই কোনো একটা ঘরে অজানা আশঙ্কায় সে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এইরকম একটা ঘরে বসেই হয়তো সে আল্লাহ্র দরবারে হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল- ‘আল্লাহ্, তুমি আমারে এই বারের জন্য বাঁচাইয়া দাও। আমি আর রাজনীতি টাজনীতি করবো না। আমার সন্তানের জন্য আমারে বাঁচাইয়া দাও। আমার মায়ের জন্য আমারে বাঁচাইয়া দাও। ফারুকী লেখেন, এ রকমই একেকটা ঘরে আমরা ১৭ কোটি মানুষ আটকা ছিলাম ১৬ বছর। আর গোপনে বলতাম, আল্লাহ্ এই ডাইনির হাত থেকে আমাদের বাঁচাইয়া দাও। সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা লেখেন, সুমনের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় উত্তরার এক হাসপাতালে লুকাইয়া থাকা অবস্থায়। ওর ভাগনে আবরারের একটা শ্যুট ছিল আমার সঙ্গে। স্পষ্ট মনে আছে ওর শেষ কথা, ‘দোস্ত, আবরাররে তুই ইজি কইরা নিস। নাইলে অ্যাকটিং খারাপ করবো। তিনি আরও লেখেন, এমনই এক জালিমের শাসনে ছিলাম যে তোর জন্য, সুমন, একটা কথাও বলতে পারি নাই। পরে জানলাম মানুষরুপী জানোয়ার জিয়াউল আহসানের নির্দেশে তোরে ইনজেকশন দিয়ে মেরে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। যে বাবার ঘরে ফিরে সন্তানের সঙ্গে ভাত খাওয়ার কথা ছিল তাকে এই ডাইনির দল শীতলক্ষ্যার মাছের খাবারে পরিণত করে। এই হায়েনাদের হয়ে যখন কেউ কথা বলতে আসে, আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। আমি আমার কমপোজার লুজ করি।
আয়নাঘর পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গী হন ভারতীয় সাংবাদিকরাও। সেখানে ছিলেন ‘ইনস্ক্রিপ্টিডটমি’-এর সম্পাদক অর্ক দেব। আয়নাঘর পরিদর্শন শেষে অর্ক দেব সেখানকার একটি ইলেকট্রিক চেয়ারের ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘এই চেয়ারটা দেখে রাখা জরুরি। ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনার আয়নাঘরের একটি কক্ষে রাখা এই চেয়ার (আগারগাঁও অঞ্চলে)। ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেকট্রিক শক দিতে ব্যবহার হতো এই চেয়ার। ডিজিএফআই’র কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) এই আয়নাঘরের দায়িত্বে ছিল। সারাক্ষণ একজস্ট ফ্যান চলতো এই ঘরগুলোতে, ফ্যান বন্ধ হলেই কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। আর কিছুক্ষণ। আজ থেকে গোটা বিশ্ব আয়নাঘরের সব ছবি দেখবে। অন্য এক পোস্টে অর্ক বলেন, এখানে বন্দি ছিলেন মাইকেল চাকমা। তিনি মাইকেল চাকমার বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ‘প্রথম যে দু’টো রুম দেখা যাচ্ছে ঠিক এই রুমগুলোর মধ্যে ১১৩ নম্বর সেল যেটি একেবারে বাথরুমের পাশে এবং সেলের ভেতর ঢোকার সময় বাঁ সাইডের কোণায় একটি সিসি ক্যামেরা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। এই সেলে আমি প্রায় দুই বছর বন্দি ছিলাম। একই লাইনের ১১৭ নম্বর রুমে ছিলাম প্রায় দেড় বছরের একটু বেশি। নিচের রুমগুলোর মধ্যে ১০৪ নম্বর রুমে ছিলাম এক বছরের কাছাকাছি। ১০৪-এর পরে ১০৫ নম্বর সেল। এরপরে টয়লেট, বাথরুম ও চুল কাটার সেল। চুল কাটার সেল নম্বর ১০৬। এ ছাড়া আরও অনেক রুমে আমাকে রাখা হয়।
উল্লেখ্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে ‘বিশেষ’ স্থানে রাখা হতো। এ নিয়ে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এসব স্থান ‘আয়নাঘর’ নামে প্রকাশ্যে আসে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর আয়নাঘর থেকে ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। তাদের বয়ানে উঠে এসেছে আয়নাঘরের ভয়াবহতা।