Image description

১৯৮২ সাল। ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে কুষ্ঠরোগ। সে সময় পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা দুজন রোগীর চিকিৎসা করছিলেন। তাঁদের ত্বকে কালো ছোপ ছোপ ক্ষত দেখা গিয়েছিল। প্রথমে সাহা ধারণা করেছিলেন, এটি কুষ্ঠরোগ। তবে পরে নানা পর্যবেক্ষণে তিনি ভিন্ন এক স্বাস্থ্য সমস্যা আবিষ্কার করেন। তাঁর মতে, এটি ছিল আর্সেনিকোসিস বা আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ফল।

ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহার এই আবিষ্কার পশ্চিমবঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানিতে ব্যাপক আর্সেনিক দূষণ সন্ধানের পথ খুলে দেয়। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আর্সেনিকোসিসকে ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিষক্রিয়ার ঘটনা’ বলে উল্লেখ করে।

সেই আবিষ্কারের চার দশক পরও, ভারতে আনুমানিক ৯ কোটি এবং বাংলাদেশে আরও ৪ কোটি মানুষ উচ্চমাত্রার আর্সেনিকে দূষিত পানি পান করছে। এত দিনেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি, বরং কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে।

ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে প্রথমবারের মতো ২০০৪ সালে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকার সমভূমিতে এই ধাতব উপাদান স্বাভাবিকভাবেই বেশি পাওয়া যায়। কারণ, হিমালয় থেকে নদীটি এই ধাতব পদার্থ বয়ে আনে।

বিজ্ঞানীদের অনুমান, আসামের ৩০টি জেলার মধ্যে ২০ টিতেই ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত সর্বোচ্চ নিরাপদ সীমা ১০ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ, প্রতি লিটার পানিতে সর্বোচ্চ এই পরিমাণ আর্সেনিক থাকলে তা সহনীয় বা তুলনামূলক নিরাপদ বলে ধরে নেওয়া হয়।

ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানী জগন্নাথ বিশ্বকর্মা বলেন, ‘আমরা লাখ লাখ মানুষের কথা বলছি, যারা হিমালয়ের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে এবং এই সমস্যার সম্মুখীন।’ তাঁর ব্যাখ্যা অনুসারে, পানি আর্সেনিক দূষণমুক্ত করতে খুব উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন হয় না। সাধারণ বালু ও লোহার পেরেক দিয়ে তৈরি ফিল্টার ব্যবহার করলেই এটি পানি থেকে সরানো সম্ভব।

ব্রিটিশ এই গবেষক আরও বলেন, ‘তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এ ধরনের ফিল্টার সরবরাহ করা কঠিন। একই সঙ্গে, পর্যাপ্ত সম্পদের অভাবে আসামের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক বিস্তারের পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করা সম্ভব হয়নি, ফলে দূষণের সঠিক মানচিত্র তৈরি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।’

তবে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকর্মা ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণার ফলে বিজ্ঞানীরা এখন আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছেন, কোথায় এবং কীভাবে বিভিন্ন মাত্রায় ও রূপে আর্সেনিকের বিস্তার ঘটে। পরিবেশে আর্সেনিক প্রধানত দুটি রাসায়নিক যৌগ অবস্থায় থাকে—আর্সেনাইট এবং আর্সেনেট।

বিশ্বকর্মার মেন্টর ও মার্কিন জৈব–রসায়নবিদ জ্যানেট হারিং ২০০৩ সালে প্রথম এই আবিষ্কার করেন। বিশ্বকর্মা বলেন, ‘এটি জানার পর মানুষ বিভিন্ন ধরনের আর্সেনিক দিয়ে দূষিত পানির জন্য ভিন্নভাবে পরিশোধন পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করে। এক পদ্ধতি সব জায়গার জন্য কার্যকর নয়, তাই প্রথমে সঠিকভাবে এলাকাভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যাটি চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

এই গবেষণা আর্সেনিক দূষণ রোধে নতুন কৌশল বিকাশের পথ সুগম করছে, পাশাপাশি এর ভৌগোলিক বিস্তৃতি সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা দিচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় অবস্থিত আসামের মতো বাংলাদেশও একই ধরনের ঝুঁকিতে আছে। কারণ, বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র থেকে দুটি নদী—পুরোনো ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা—বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সত্তরের দশকে বাংলাদেশ ডায়রিয়ার মতো পানিবাহিত রোগে প্রচুর শিশুর মৃত্যু হতো। ওই সময় সরকারি উদ্যোগে ইউনিসেফ এবং আরও কিছু সংস্থার সহায়তায় দুই দশকের মধ্যে দেশজুড়ে লাখ লাখ নলকূপ বসানো হয়। এতে দ্রুতই শিশু মৃত্যুর হার কমে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে এসে জানা যায়, এসব নলকূপের পানিতে বিপুল পরিমাণে আর্সেনিক রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর আর্সেনিকের বিষক্রিয়া থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যায় মারা যান অন্তত ৪৩ হাজার মানুষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর্সেনিককে মানবদেহের জন্য কার্সিনোজেনিক বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে থাকার ফলে ক্যানসার, ত্বকের ক্ষত, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো নানা অসংক্রামক রোগ হতে পারে বলে উল্লেখ করেছে।

আসামে জন্মগ্রহণ করা বিশ্বকর্মা বলেন, ‘আমি নিজ চোখে দেখেছি কীভাবে মানুষ প্রতিদিন নিরাপদ পানির জন্য লড়াই করছে। সম্ভবত এ কারণেই আমি পরিবেশ বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকেছি—এটি ছিল আমার খুবই সচেতন একটি সিদ্ধান্ত, কারণ আমি এ বিষয়ে কিছু করতে চেয়েছিলাম।’

বিশ্বকর্মা শিগগির আসামে ফিরে যাচ্ছেন একটি বড় পরিসরের মাঠ গবেষণার জন্য। যেখানে তিনি মাটি থেকে জীবাণু এবং অন্যান্য উপাদানের নমুনা সংগ্রহ করবেন, যা সঠিক পরিশোধন কৌশল ও নীতিমালা নির্ধারণে সহায়তা করতে পারে। তাঁর গবেষণা দূষিত ভূগর্ভস্থ পানির সমস্যায় ভুগতে থাকা অন্যান্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় আর্সেনিক দূষণ সবচেয়ে প্রকট হলেও, এটি পৃথিবীর বায়ু, পানি এবং ভূমির প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে। ৭০ টিরও বেশি দেশে পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণের উপস্থিতি নথিভুক্ত করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ কোটি মানুষের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। চীন, আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর পানীয় জলে আর্সেনিকের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) পানি বিশেষজ্ঞ জো আয়ট এবং তাঁর সহকর্মীদের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ গৃহস্থালির কূপ থেকে পানি ব্যবহার করে, যা আর্সেনিক দ্বারা দূষিত হওয়ার সমূহ শঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই ইউনিসেফ কাজ করছে। নিয়মিত নলকূপ পরীক্ষার কাজ চলছে। এ নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডও রয়েছে। তবে পানি থেকে আর্সেনিক আলাদা করার কোনো প্রযুক্তিই এখনো পর্যন্ত তেমন একটা কার্যকরী নয়।

এর একটাই সমাধান, তা হলো গভীর নলকূপ স্থাপন। কিন্তু সবার সামর্থ্যে কুলায় না। ফলে আর্সেনিক ঝুঁকি থাকছেই।

তথ্যসূত্র: ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাময়িকী জিওগ্রাফিকাল ইউকে