সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী এবং জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসনের এমপি মির্জা আজম। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। চীন সফর করে দেখে আসেন বিশাল নকশিপল্লী। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দেশের চাহিদা বিবেচনা না করেই আকাশকুসুম নকশিপল্লী প্রকল্প নিয়ে ফেলেন। বিশাল ফসলি জমি নষ্ট হলেও তার ধার ধারেননি তিনি। তখন পরিকল্পনামন্ত্রীসহ অনেকেই বিরোধিতা করেছিলেন এই আকাশকুসুম নকশিপল্লীর। তবে নকশিপল্লীর নামের আগে শেখ হাসিনার নাম লাগিয়ে তিনি সবার মুখে কুলুপ এঁটে দেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ের শেখ হাসিনা নকশিপল্লীর প্রথম পর্যায় (জমি অধিগ্রহণ ও ভূমি উন্নয়ন) অনুমোদন করিয়ে নিলেও পাঁচ বছরেও কাজ শুরু করতে পারেননি মির্জা আজম। প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অনেকের মতে, সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে আগের প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সম্পর্কের টানাপড়েনে কাজটি এগোয়নি। আবার ৩০০ একর ফসলি জমি নষ্ট করে এত বড় নকশিপল্লী করার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের অনেকে আগ্রহী ছিলেন না।
তাঁত বোর্ডের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এত বড় প্রকল্প নেওয়ার ব্যাপারে তখন আমরা অনেকেই রাজি ছিলাম না। শুধু নিজের স্বার্থ হাসিলে মির্জা আজম একক সিদ্ধান্তে এত বড় প্রকল্প নেন।’
এ বিষয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে এমন অনেক প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে বাছবিচার ছাড়া, যেগুলো থেকে এখন কোনো অর্থনৈতিক আউটপুট আসছে না। অনেক এমন প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে যার যৌক্তিকতা নেই। এখন সরকার অনেক প্রকল্প থেকেই অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ বাদ দিচ্ছে। অনেক প্রকল্পে ঋণ নিয়ে বিপাকে রয়েছে খোদ সরকারও।
সম্প্রতি সরেজমিনে জামালপুরের নকশিপল্লী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খালের পারেই চোখ-জুড়ানো ফসলের মাঠ। মফিজ (৪৪) নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমার জমি যদি সরকার নিয়ে নেয়, আমি বেকার হয়ে যাব। আমার জমি অত্যন্ত উর্বর, এখানে বছরে তিনটি ফসল হয়। ধান, সরিষা, শসা, পাট—সবই ফলাতে পারি।’
আলাউদ্দিন (৫০) নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘আমার ৫২ শতাংশ জমি রয়েছে। এখানে তিনটি ফসল হয়ে থাকে। এক লাখ টাকা ইনকাম হয়, যা আমার আট সদস্যের পরিবারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জমি নিয়ে নিলে আমরা কী করব? এটা ছাড়া তো আমাদের গতি নেই।’
জানা গেছে, শেখ হাসিনা নকশিপল্লী প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে এখন ‘জামালপুর নকশিপল্লী’ করা হচ্ছে। প্রকল্পের খরচ কমানোর প্রস্তাবসহ নতুন ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ৭২২ কোটি টাকার জমি অধিগ্রহণের প্রকল্পটিতে এখন ২০০ কোটি টাকার মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫০০ উদ্যোক্তার জন্য নকশিপল্লী তৈরি করার প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে, যা আগে সাড়ে তিন হাজার উদ্যোক্তার জন্য করার কথা ছিল।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) মো. আইয়ুব আলী বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ পাঁচ বছর হয়ে গেলেও এখনো কোনো অর্থছাড় হয়নি। প্রথমে এটি ৭২২ কোটি টাকা বাজেটে করার পরিকল্পনা ছিল, তবে এখন তা কমিয়ে ১০০ একর জায়গায় ২০০ কোটি টাকার মধ্যে করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
তবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নকশিপল্লী বাদ বা ছোট আকারে প্রকল্পটি নেওয়া হবে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। আমরা প্রকল্পটির সার্বিক চিত্র বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরব। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেন সে অনুযায়ী কাজ করা হবে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা নকশিপল্লী প্রকল্পটি জামালপুরের কম্পুর এলাকায় শিল্পী, হস্তশিল্পী ও তাঁতিদের জন্য একটি বিশেষায়িত অঞ্চল তৈরির উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল, যা ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অনুমোদন করে এবং জুন ২০২৫-এর মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
সম্প্রতি প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। মিটিংয়ে উপস্থিত ছিল বস্ত্র-পাট মন্ত্রণালয়, তাঁত বোর্ড, পরিকল্পনা কমিশন এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধি। প্রকল্পের জমির পরিমাণ যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ, প্রকল্পের স্কোপ পুনর্নির্ধারণ এবং সে আলোকে ডিপিপি সংশোধন করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, যদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়, তবে সরকারের অর্থনৈতিক টেকসইতা এবং মানুষের স্বার্থের জন্যই বাদ দেওয়া হবে।