![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/c6ea050a971dbb74355e77b60ac705d2.png)
বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড থেকে সরকারের পাঁচ কর্মকর্তা বেশ কয়েক বছর আগে অনুদান পেয়েছিলেন। অনুদান পাওয়া–সংক্রান্ত তথ্যের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য সরকারি ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত ছিল। অপরাধীরা এই তালিকা সংগ্রহ করে অনুদান পাওয়া কর্মকর্তাদের ফোন করে। তারা কর্মকর্তাদের আরও অনুদান দেওয়ার কথা বলে তাঁদের ব্যাংক কার্ডের তথ্য নেয়। এরপর জালিয়াতির মাধ্যমে পাঁচজনের কাছ থেকে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় অপরাধীরা।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্য উন্মুক্ত থাকা অনেকটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনা দেশে প্রায়ই ঘটছে। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, যারা মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের সবচেয়ে বড় ভান্ডার, তাদের থেকেই তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ফলে মানুষ প্রতারণাসহ নানা ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
গত দুই বছরে দেশে কিছু আলোচিত তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ গতকাল সোমবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তৃতীয় পক্ষের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য ফাঁস করেছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ব্যক্তিগত তথ্য কী
একজন মানুষকে আলাদা করে শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় যেসব তথ্য রয়েছে, সেগুলোই ব্যক্তিগত তথ্য। যেমন ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, স্বাক্ষর, ফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, জন্মতারিখ, আঙুলের ছাপ, আইরিশ (চোখের মণির ছবি) ইত্যাদি।
এর বাইরে রয়েছে স্পর্শকাতর তথ্য। এগুলোর মধ্যে আছে জাতিগত পরিচয়, লিঙ্গ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্য, ব্যক্তিগত সম্পর্কের তথ্য, আর্থিক তথ্য, পেশাগত তথ্য ও ডিজিটাল তথ্য। আর্থিক তথ্যের মধ্যে আছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, টাকার পরিমাণ, পিন নম্বর, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, লেনদেনের তথ্য। পেশাগত তথ্যের মধ্যে আছে কর্মস্থল, পদবি, বেতন ও পদোন্নতির তথ্য। ডিজিটাল তথ্যের মধ্যে আছে ছবি, ভিডিও, অডিও, লিখিত কোনো কনটেন্ট, ই–মেইল ঠিকানা, পাসওয়ার্ড, পিন নম্বর, মোবাইলের লোকেশনের তথ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইলের লিংক ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসে কী ক্ষতি
মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হলে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, তার উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক আছে।
টাকা হাতিয়ে নেওয়া: মুঠোফোন থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় ফরিদপুরের একটি গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে ‘প্রতারকদের গ্রাম’ নামে। এই গ্রামের প্রতারকেরা গ্রাহকদের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে। তারা গ্রাহকদের ফোন দিয়ে কৌশলে পিন নম্বর নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংকঋণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সিলেট কার্যালয়ে ২০১১ সালে ‘মো. ফারুক মিয়া’ নামের এক ব্যক্তি প্রথমে অস্থায়ী ও দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ‘হেলপার-টু-প্লাম্বার’ পদে নিয়োগ পান। ২০১২ সালে নিয়মিত কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ হয় তাঁর। পরবর্তী সময়ে চাকরিবিধি অনুসরণ করে অগ্রিম গৃহনির্মাণের জন্য দুই কিস্তিতে ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নেন তিনি। ঋণ নেওয়ার পর তিনি উধাও হয়ে যান। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁকে খুঁজতে গিয়ে জানতে পারে, ফারুক আসলে মিনহাজ। তিনি অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষাগত সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেন, ঋণ নেন।
ভুয়া সম্পত্তি হস্তান্তর: জাতীয় পরিচয়পত্রের সব তথ্য ঠিক রেখে শুধু ছবি পরিবর্তন করে সম্পত্তি হস্তান্তরের মতো ঘটনা দেশে ঘটেছে। সরকারের পাওনা টাকার দায় এড়াতে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পরিবার অভাবনীয় জালিয়াতি করেছে। এই পরিবারের নামে থাকা একটি কোম্পানির মালিকানা তিন ব্যক্তির নামে হস্তান্তর করা হয়। এই তিন ব্যক্তির দাবি, তাঁরা এই কোম্পানি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এ ক্ষেত্রে তিন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে এই প্রতারণা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
সিম তুলে প্রতারণা: দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌস। ২০২২ সালের আগস্টে তাঁর বাড়িতে তিন যুবক আসেন। তাঁরা একটি মুঠোফোন কোম্পানির সিম কার্ড বিনা মূল্যে দিচ্ছিলেন। তাঁদের কাছে থেকে সিম কার্ড নেন জান্নাতুল। যুবকেরা জান্নাতুলের আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি নেন। এরপর গত জুলাইয়ে থানা থেকে জান্নাতুলকে নোটিশ করা হয়। বলা হয়, তাঁর সিম দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। অর্থাৎ জান্নাতুলের আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে অপরাধী চক্র আর্থিক প্রতারণা করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা: অন্যের ছবি, নাম-পরিচয় চুরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এমনকি অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে বিভিন্নজনের কাছে টাকাও চাওয়া হয়।
আর্থিক তথ্য: ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, টাকার পরিমাণ, পিন নম্বর, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, লেনদেনের তথ্য ইত্যাদি ফাঁস হলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। যেমন একটি সুপারশপের বিক্রয়কর্মী ছিলেন শরিফুল ইসলাম। সুপারশপে কেনাকাটা করতে আসা গ্রাহকদের তথ্য চুরি করে ব্যাংকের এটিএম কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নিতেন তিনি। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছিল, তথ্য চুরি করে হুবহু এটিএম কার্ড তৈরি করতেন শরিফুল। পরে কার্ড দিয়ে গ্রাহকের টাকা তুলে নিজের ও স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতেন।
স্পর্শকাতর তথ্য: জাতিগত পরিচয়, লিঙ্গ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, স্বাস্থ্যগত তথ্য, ব্যক্তিগত সম্পর্কের তথ্য ফাঁস হলে একজন ব্যক্তি সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। ধরা যাক, কেউ লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষ বা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ। তাঁর এ-সংক্রান্ত তথ্য যদি ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে তিনি উগ্রবাদীদের দ্বারা ক্ষতির শিকার হতে পারেন।
করণীয় কী
ব্যক্তিসংশ্লিষ্ট তথ্য যদি ফাঁস হয়, তাহলে তা শুধু নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্যই ক্ষতির কারণ হয় না, পরিবারও ক্ষতির মুখে পড়ে। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের বিপরীতে সরাসরি কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। তবে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য সরকার একটি আইনের খসড়া করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের ডিভিশন অব ইনফরমেশন টেকনোলজির ওয়েবসাইটে গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ব্যক্তিগত পরিচয়সংক্রান্ত তথ্য চুরি কোনো মজার বিষয় নয়। কারও ব্যক্তিগত বা আর্থিক তথ্য চুরি বা ফাঁস হলে প্রথম হয়তো তা বোঝা যায় না। কিন্তু যখন বড় একটি বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় বা ঋণদাতার কাছ থেকে হঠাৎ ফোন আসে, তখন বিপদ টের পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেনও মনে করেন, মানুষ বুঝতেই পারে না ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হলে তার পরিণতি কী হতে পারে। সচেতনতার অংশ হিসেবে গ্রাহকের দিক থেকে বিশ্বস্ত জায়গা ছাড়া অন্যত্র ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে আসা উচিত নয়। পাবলিক জায়গায় সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। যেসব অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে আগেই ভালোভাবে জানা উচিত।
এই অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার যেহেতু অনেক কম, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে মানুষের সচেতনতা কম, তাই সেবাদাতাদের সুরক্ষার বিষয়ে জোর দিতে হবে। তারা তথ্যগুলো দিয়ে কী করছে, তার জবাবদিহি থাকা উচিত। তথ্য যাচাইয়ের বিষয়টি কয়েক ধাপে হওয়া উচিত। পাশাপাশি দরকার আইনি সুরক্ষা। আর ব্যক্তিগত তথ্য যদি ফাঁস হয়েই যায়, তবে বুঝতে পারামাত্রই দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি ঝুঁকি এড়াতে পাসওয়ার্ড, ফোন নম্বর, ই–মেইল পরিবর্তন করা যাতে পারে।