![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/1789bd91b36adf1999877070a2b46702.png)
৫ আগস্ট থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি। রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১৮০তম দিনেই ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দেন। তার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে যে— তার দল আওয়ামী লীগ হয়তো প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করছে।
ফেসবুকে দেওয়া একটা পোস্ট তাই বাংলাদেশি তরুণরা দ্রুত লুফে নেয়। সেই পোস্ট সন্ধ্যা নাগাদ, ঢাকার কেন্দ্রস্থলে কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীর সমাবেশ ঘটায়। হাসিনা তার বক্তৃতা শুরু করার সময় ধানমন্ডি ৩২-এর ঐতিহাসিক ভবনটির সামনে কয়েকটি বুলডোজারও আনা হয় এবং তখন এটি কার্যত আগুনে জ্বলছিল। পরে হলুদ ডোজারের বড় ধাতব ব্লেডগুলো বাড়িটির একটি ভবন ধ্বংস শুরু করে যেখান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এই ঘটনাটি অনেককে, এমনকি বাংলাদেশের এস্টাবলিস্টমেন্ট সদস্যদেরও বিস্মিত করে। প্রায় ৪০ জন সেনা সদস্য রাস্তার মুখে গিয়ে ওই বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তারা বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের মুখে সেখান থেকে সরে যান।
পরদিন সূর্যোদয়ের সময় বাংলাদেশ কার্যত একটি পরিবর্তিত ল্যান্ডস্কেপে জেগে ওঠে— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করতে পারেনি তা ওই রাতের ৯ ঘণ্টায় ঘটেছিল। ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটিতে ইট ও ছাই-এর ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
কিন্তু কোনও ভুল বুঝবেন না। এরা বিক্ষুব্ধ জনতা বা ধর্মান্ধরা নয় যারা ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা করছে বা বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের আগের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে যখন দেশটি পাকিস্তানের অংশ ছিল। বাড়িটি ভাঙার সাথে সাথে যারা হাততালি, উল্লাস ও সেলফি তুলেছিলেন তাদের মধ্যে দেশের ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং শহুরে মানুষও দাঁড়িয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে হাসিনা ও তার দোসরদের হাতে তাদের ভোটাধিকার হরণ হতে দেখেছে তারা। বিক্ষোভেকারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা হাসিনার শাসনামলে একের পর এক কারচুপির নির্বাচনের কারণে তাদের জীবনে কখনো ভোটই দিতে পারেননি।
অবশ্য ভোটে কারচুপি করলেও মানুষের সমর্থন জোগাড় করার জন্য হাসিনা তার বাবার উত্তরাধিকার এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছেন। এই কাজটা তিনি এতটাই করেছেন যে— সাধারণ বাংলাদেশিরা মুজিবকে হাসিনা থেকে আলাদা করা ক্রমশ কঠিন মনে করছে। উভয়ই দুঃখজনকভাবে একে অন্যের সাথে জড়িয়ে পড়েছে এবং দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর সেখানেও নিজেকে পররাষ্ট্রনীতির জালে আটকে ফেলেছে।
ঢাকায় আবেগ তুঙ্গে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ এহতাশাম হক বলেছেন, “লাখ লাখ ভুক্তভোগী মানুষ তাদের নিপীড়কের প্রতীককে সম্মান করবে বলে আপনি আশা করেন?— যা কিনা ইট-বালি দিয়ে তৈরি একটি বাড়ি… আপনি কি আমাদের কাছ থেকে চুরি করা সম্পদ ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আমাদের দেশবাসীর কাছ থেকে নৃশংসভাবে কেড়ে নেওয়া চোখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফিরিয়ে আনতে পারবেন? আজকে ভেঙ্গে ফেলা প্রতিটি ইট ন্যায়বিচারের একটি ছোট কাজ, ক্ষতিপূরণের প্রতীক যা তাদের নিপীড়কের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে।”
শেখ হাসিনা মুজিবকে গুম, অপশাসন, দুঃশাসন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতীকে পরিণত করেছেন। তার বাড়ি, যাকে একসময় বাংলাদেশিদের গর্বের স্মারক হিসেবে দেখা হতো, এখন হাসিনার সমার্থক হয়ে উঠেছে।
ভারতের আওয়ামী লীগ সমস্যা
শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেল মিয়ানওয়ালিতে বন্দি ছিলেন তখন তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা করার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তাজউদ্দীনকেও হত্যা করা হয়, তার পরিবারের দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য ছাড়া সকলকে। তাজউদ্দীনের বিধবা স্ত্রী ও সোহেল তাজের মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করেন এবং ১৯৭৭ সালে দলটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।
এটা কিছুটা আশ্চর্যের বিষয় যে, ধ্বংসযজ্ঞের একদিন পরও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সোহেল তাজ কোনও কটাক্ষ করেননি। কারও নাম না করে তিনি তার দলের দুঃখজনক অবস্থার জন্য ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা হাসিনার ওপরই দোষারোপ করেছেন। তিনি বলেন, “কেউ একজন এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলের সুনামই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।”
যতবারই মিডিয়ায় হাসিনার কর্মকাণ্ডের খবর প্রকাশিত হয় ততবারই হাসিনার প্রতি ভারতের নিরবচ্ছিন্ন এবং অটল সমর্থনের প্রশ্নটিও তুলে ধরা হয়। কয়েকদিন আগে, হাসিনা তার দলের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন— যারা তার বিরোধিতা করেন তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দিতে। একটি অডিও ক্লিপে তাকে বলতে শোনা যায়, “শুধু তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিন।”
এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে— হাসিনা কোনও দালাই লামা নন যে এটি বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে নৈতিক সংকটে ফেলবে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতের একমাত্র মিত্র। কিন্তু হাসিনাকে বাংলাদেশে পুনর্বাসন করা প্রায় অসম্ভব কাজ, বিশেষ করে যখন সারা দেশে তার নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি যখন এখনও জনসাধারণের স্মৃতিতে তাজা। ৩২ নম্বর রোডে মুজিবের বাড়ি ভাঙা তেমনই একটি ঘটনা।
অবশ্য হাসিনা সেই বক্তৃতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, তার বিরোধীরা বিশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল— হাসিনার বিরুদ্ধে বিপ্লবে অংশ নেওয়া দল ও অংশীজনের মধ্যে মতবিরোধের লক্ষণও দেখা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু হাস্যকরভাবে, হাসিনা সফলভাবে তার বিরোধীদের আবারও একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যে মুহূর্তে হাসিনার ছায়া দিগন্তে আবির্ভূত হয়েছে, সেসময়ই তাদের মধ্যে যে কোনও মত-পার্থক্য ছিল তা খুব দ্রুতই তারা ভুলে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) বেশ বিশ্রী অবস্থানে ফেলেছে। ভারতকে খুশি করতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চিন্তার বিরোধিতা করেছে দলটি। ভারতবিরোধী বক্তব্য না দেওয়ার ও ছড়ানোর ব্যাপারেও সতর্ক রয়েছে বিএনপি। কিন্তু দিনশেষে দলটির নেতাদের জয়ের জন্য নির্বাচনের সম্মুখীন হতে হবে— আর তাই বিএনপি কতদিন তার কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে তা বিতর্কের বিষয়ও বটে।
ভারতকে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখতে হবে, যারা বছরের পর বছর ধরে হাসিনার হাতে নিজেদের মৌলিক মানবিক মর্যাদা পদদলিত হতে দেখেছে। এবং হাসিনার হাতে কেবল দুটি অস্ত্র ছিল— তার বাবার উত্তরাধিকার এবং ভারতের সমর্থন। মুজিবের ঐতিহাসিক বাড়ি ধ্বংসকে এই আলোকে দেখা উচিত এবং বিপুল সংখ্যক জনগণের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে বিরাজমান ব্যাপক ক্ষোভকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা উচিত।
নয়া দিল্লিকে অবশ্যই তার সকল অহংকার নিজেকেই গ্রাস করতে হবে এবং বুঝতে হবে যে— তারা এমন একটি দেশের স্বৈরশাসককে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করেছে যার সাথে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত রয়েছে তাদের। শুধু প্রয়োজন সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো বাস্তববাদীতা। এমনকি অতীতে যখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল তখনও তিনি বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিজের উদ্যোগে তার হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি।
ট্রাম্পের লেনদেন-ভিত্তিক বিশ্ব
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন বাস্তববাদী। তার বিশ্ব হচ্ছে লেনদেন-ভিত্তিক, যেখানে সর্বোচ্চ দরদাতা যা চায় সেটাই পায়। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বাংলাদেশ বৈশ্বিক দুই পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরে কৌশলগতভাবে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের অবস্থানকে প্রাণকেন্দ্রে হিসেবে দেখে থাকে চীন। যদি কখনও দক্ষিণ চীন সাগরে নৌ-অবরোধের মুখে পড়তে হয় সে ক্ষেত্রে সমুদ্রপথে যাওয়ার জন্য বার্মা বা বাংলাদেশ অথবা উভয়েরই প্রয়োজন হবে চীনের। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক পিভটেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।
বর্ষা বিপ্লব বাংলাদেশকে উভয় পরাশক্তির সাথে সঠিকভাবে দর কষাকষির অনন্য অবস্থান দিয়েছে। যেখানে ভারতের সাউথ ব্লক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার কল্পনায় স্থির রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে, সেখানে চীন ঢাকার নতুন শাসন ব্যবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশে নতুন বন্ধু তৈরি করতে হবে। সাধারণ বাংলাদেশিদেরকে “পাকিস্তানের প্রেতাত্মা” হিসাবে চিত্রিত করা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য ভালো হতে পারে এবং পশ্চিমবঙ্গে কিছু ভোট জিততে সাহায্য করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই কৌশল একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশে সবকিছু হারানোর মতোই ক্ষতিকরহতে পারে।
বাংলাদেশের বিষয়ে চীন বরাবরের মতোই বাস্তববাদী। তবে এর ভারতের নীতি ৭৭ বছর বয়সী ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যিনি (হাসিনা) হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য দায়ী। ভারতের এই অবাস্তববাদী নীতির প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও উদ্বেগজনক, কারণ চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ওপর নির্ভর করে থাকে ওয়াশিংটন।