আর্থিক দুর্নীতি, বিদেশ সফর, ক্লাবে মদের নেশায় বিভোর থাকা, নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণসহ অসংখ্য অভিযোগ মাথায় নিয়েই দায়িত্বে বহাল আছেন সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ‘এসপায়ার টু ইনোভেট’ (এটুআই) প্রোগ্রামে কর্মরত ইউএনডিপির নয় পরামর্শক। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের চুক্তি বাতিল করে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু সেই আহ্বান উপেক্ষা করেন বাংলাদেশে অবস্থিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধি। উল্টো তাদেরকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
মূলত, দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে গত ১৫ বছর ধরে চলা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপকভাবে সামনে আসে গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। খাতটি দেশের ডিজিটাল উন্নয়নের মেরুদণ্ড হলেও অভিযোগ ওঠে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির। বিভিন্ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো, দুর্নীতি করা, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না দেওয়া, বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থের অপব্যবহার, কম দামি জিনিস বেশি দেখিয়ে কেনা, টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার বিষয়গুলো প্রাথমিকভাবে উত্থাপিত হয়। শুরুতে ব্যাপক অভিযোগের কারণে এটুআই প্রোগ্রামে কর্মরত ১৪ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরামর্শকের নাম সামনে আসে। যাদের মধ্যে নয় পরামর্শক ছিলেন ইউএনডিপির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। পরে বিষয়টি আমলে নিয়ে স্বল্প সময়ে ব্যবস্থা নেয় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
বিভিন্ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো, দুর্নীতি করা, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না দেওয়া, বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থের অপব্যবহার, কম দামি জিনিস বেশি দেখিয়ে কেনা, টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার বিষয়গুলো প্রাথমিকভাবে উত্থাপিত হয়। শুরুতে ব্যাপক অভিযোগের কারণে এটুআই প্রোগ্রামে কর্মরত ১৪ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরামর্শকের নাম সামনে আসে। যাদের মধ্যে নয় পরামর্শক ছিলেন ইউএনডিপির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত
১৪ কর্মকর্তাকে দাপ্তরিক দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার নির্দেশ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর শুরুতে এটুআই প্রকল্পের নানা অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের বিষয়গুলো আমলে নিয়ে গত বছরের ২০ আগস্ট (মঙ্গলবার) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এটুআইয়ের ১৪ কর্মকর্তাকে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা জারি করে। অভিযুক্তরা হলেন— পলিসি অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরী, ই-গভর্নমেন্ট অ্যানালিস্ট মো. ফরহাদ জাহিদ শেখ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মো. মাজেদুল ইসলাম, এইচডি মিডিয়ার প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট পূরবী মতিন, টেকনোলজি অ্যানালিস্ট মো. হাফিজুর রহমান, ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদ, রিসোর্স মবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট মো. নাসের মিয়া, ডিএফএস স্পেশালিস্ট মো. তহুরুল হাসান, সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামী, এসপিএসের সিনিয়র কনসালটেন্ট এইচএম আসাদ-উজ্জামান, ই-নথি ইমপ্লিমেন্টেশন এক্সপার্ট এটিএম আল ফাত্তাহ, সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তানভীর কাদের ইমন, অ্যাডমিনের কনসালটেন্ট মো. ওমর ফারুক ও প্রকিউরমেন্টের সিনিয়র কনসালটেন্ট মো. সালাউদ্দিন।
এর মধ্যে নয়জন ইউএনডিপি নিযুক্ত পরামর্শক হওয়ায় সংস্থাটির বাংলাদেশ আবাসিক প্রতিনিধির কাছে আচরণগত অভিযোগ তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠিও পাঠানো হয়। আইসিটি বিভাগের উপসচিব জিল্লুর রহমানের পাঠানো ওই চিঠিতে নৈতিক নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, আইসিটি বিভাগ সম্প্রতি ইউএনডিপি বাংলাদেশে নিযুক্ত কিছু পরামর্শদাতার বিরুদ্ধে তাদের আচরণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে অভিযোগের বিষয়ে জানতে পেরেছে। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এটি আইসিটি বিভাগ ও ইউএনডিপি বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ উদ্যোগ এবং সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে। সেজন্য যৌথ উদ্যোগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আইসিটি বিভাগ ইউএনডিপিকে অনুরোধ করে যে, তাদের অফিস দ্রুত অভিযোগগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত যেন শুরু করে।
একই সঙ্গে এ বিষয়ে আইসিটি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় যেকোনো সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়টিও চিঠিতে নিশ্চিত করা হয়।
গত ৩১ আগস্ট এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে তৎকালীন আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মুহম্মদ মেহেদী হাসানকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।
তদন্তে কমিটির প্রশ্নের জবাব দেননি অভিযুক্তরা
জানা গেছে, তদন্ত কমিটি গঠন করার পর কাজের কৌশল, তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পাঁচটি সভা করা হয়। পাশাপাশি কমিটির পক্ষ থেকে এটুআইয়ের কাছে বিভিন্ন তথ্য চেয়ে মোট ছয়টি চিঠি পাঠানো হয়। একই সঙ্গে তদন্ত কাজে কমিটিকে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সহায়তা করার জন্য গত ১২ সেপ্টেম্বর একটি গণবিজ্ঞপ্তি আইসিটি বিভাগ ও এটুআই প্রকল্পের ওয়েবসাইট এবং নোটিশ বোর্ডে প্রকাশ করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ই-মেইলের মাধ্যমে আটটি এবং ব্যক্তির মাধ্যমে একটি; অর্থাৎ মোট নয়টি অভিযোগ তদন্ত কমিটির কাছে আসে। যা আমলে নিয়ে পরে দুদিন অভিযোগকারীদের শুনানি গ্রহণ করা হয়। শুনানি শেষে অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্তদের বক্তব্য জানতে লিখিত জবাব (প্রমাণসহ) ১৪ অক্টোবর তদন্ত কমিটির সভাপতির কাছে পাঠানোর জন্য প্রত্যেক পরামর্শকের কাছে চিঠি ও ই-মেইল করা হয়। ১৭ অক্টোবর সকাল ১০টায় তদন্ত কমিটির সভায় উপস্থিত হয়ে অথবা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মৌখিক বক্তব্য দেওয়ার জন্যও বলা হয়।
বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের হোতা এসব অভিযুক্ত ব্যক্তির চুক্তি বাতিল করার মাধ্যমে কাজে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে ইউএনডিপিকে বারবার জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি— এমন অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নয় পরামর্শকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ জানান। উল্টো তিনি আইসিটি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আগারগাঁও আইডিবি ভবনের ১৯ তলায় ইউএনডিপির অফিসে ওই নয় অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে তাদের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দেন
এর জবাবে বাংলাদেশ সরকারের পাঁচজন পরামর্শক ১৪ অক্টোবরের মধ্যে তাদের লিখিত জবাব দেন এবং ১৭ অক্টোবর শুনানিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরামর্শক অ্যাডমিন ওমর ফারুক ও সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তানভীর কাদের ইমন সভায় উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন।
তবে, তদন্ত কমিটির কাছে কোনো জবাব দেননি ইউএনডিপির নয় পরামর্শক। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র সল্যুশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামি ১৪ অক্টোবর লিখিত জবাব জমা দিয়ে ১৫ অক্টোবর তা প্রত্যাহার করে নেন। বাকি আটজন ই-মেইলের মাধ্যমে দুই-তিনদিন সময় বাড়ানোর আবেদন জানান। পরবর্তীতে তারা সবাই ফের ই-মেইলে জানান যে, ইউএনডিপি তাদের নিয়োগকারী। অভিযোগের বিষয়ে লিখিত জবাব দেওয়ার বিষয়ে তারা ইউএনডিপি হতে কোনো সম্মতি পাননি। তাই তাদের পক্ষে কোনো লিখিত জবাব দাখিল করা সম্ভব নয়।
পরামর্শকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়, তদন্তে সহায়তা করেনি ইউএনডিপি
আইসিটি বিভাগের তদন্তে উঠে আসে ইউএনডিপির নয় পরামর্শকের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ। এসব অভিযোগের অনেকগুলোই নিয়োগকারী সংস্থা ইউএনডিপির অসহযোগিতার কারণে সত্যতা যাচাই করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।
সূত্র বলছে, ইউএনডিপির প্রোগ্রাম অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী দেশের আইসিটি সেক্টরের নানা অপকর্মের মূলহোতা— এমন অভিযোগের তদন্ত করেছে কমিটি। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কোম্পানিকে বারবার কাজ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে সহকর্মীদের সরাসরি নির্দেশনার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা না হয়েও অনীর চৌধুরীর সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার করার বিষয়টিও তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। যদিও এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটির কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেননি তিনি।
তবে, অভিযোগ তদন্ত করে পর্যালোচনা ও মতামতে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আনীর চৌধুরী এটুআই প্রোগ্রামের শুরু থেকে নেতৃত্ব দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার নাগরিকত্ব রয়েছে। অভিযোগ আছে, তিনি প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় ইউএনডিপি ও এটুআইয়ের ওপর তার ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করেছেন। তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত সংস্থা থেকে আরও অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
বিস্তর অভিযোগ প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মো. মাজেদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এটুআই প্রকল্পে আর্থিক দুর্নীতি, দুর্নীতির টাকা দিয়ে ব্যাপক বিদেশ সফর, অফিস শেষে সহকর্মীদের নিয়ে ক্লাবে নেশায় মত্ত থাকা, নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া, একই ভাউচার ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ সরকারকে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা, ছয়টি ল্যাপটপ কেনার নামে ছয়টি দামি মোবাইল ভেন্ডরের কাছ থেকে নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
আরেক পরামর্শক ই-গভর্নমেন্ট অ্যানালিস্ট ফরহাদ জাহিদ শেখের বিরুদ্ধে কোভিডের সময় ডাক্তার ও সেবাসংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্ম তৈরির টাকা আত্মসাৎ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তার পরিচিত প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, কর্মশালার নামে অর্থ আত্মসাৎ এবং নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ পরামর্শকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, তিনি ইউএনডিপির পরামর্শক হয়েও বিধিবহির্ভূতভাবে সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন।
প্রচারণামূলক কাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট (এইচডি মিডিয়া) পূরবী মতিনের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে এটুআইতে কর্মরত থেকে নিজের টিমের মাধ্যমে অবৈধভাবে রাজনৈতিক দলের প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন— এমন অভিযোগেরও তদন্ত করেছে কমিটি। যার পর্যালোচনায় তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মতিন বিভিন্ন ভেন্ডরের নামে কাজ নিয়ে নিজস্ব টিম বা প্রোডাকশন ইউনিটের মাধ্যমে কাজ করে নিজেই অর্থ গ্রহণ করতেন।
অবাস্তব প্রকল্প গ্রহণ করতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চাপ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে পরামর্শক ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদের বিরুদ্ধে। তিনি তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পলককে ব্যবহার করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপ দিতেন অপ্রয়োজনীয় ও বাস্তবতা-বিবর্জিত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিতে। একই সঙ্গে নারী উদ্যোক্তা সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিষয়গুলোও সামনে এসেছে।
রিসোর্স মোবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট মো. নাসের মিয়ার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করেছে কমিটি। একই সঙ্গে তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করার জন্য উপযুক্ত তদন্ত সংস্থার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি।
কর্মশালা আয়োজনের নামে অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস স্পেশালিস্ট তহরুল হাসান টুটুলের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে জনগণের টাকা ব্যবহার করে পেমেন্ট গেটওয়ে ‘একপে’ তৈরি করা এবং এ প্লাটফর্মের অ্যাকাউন্টে অর্জিত সুদ ও সার্ভিস ফির টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনুমোদনহীন প্ল্যাটফর্ম একপের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টির সত্যতা রয়েছে বলেও তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে।
জনগণের টাকায় নিজস্ব প্লাটফর্ম গড়ে তুলেছেন সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামি। তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে এটুআইকে ব্যবহার করে ই-কমার্স বাণিজ্যে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি বিনিয়োগ এবং সরকারি ডাক ব্যবস্থা ব্যবহার করে ‘একশপ’, ‘একপাস’, ‘ডিজিবক্স’ ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে জনগণের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তারা বিরুদ্ধে।
টেকনোলজি অ্যানালিস্ট মো. হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় অনিয়ম এবং ভেন্ডারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করেছে কমিটি।
অন্যদিকে, ইউএনডিপির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ওই নয় পরামর্শকের বিষয়ে ইউএনডিপি ও সংশ্লিষ্ট পরামর্শকদের কাছ থেকে কোনো তথ্য ও সহযোগিতা তদন্ত কমিটি পায়নি বলেও জানা গেছে।
বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের হোতা এসব অভিযুক্ত ব্যক্তির চুক্তি বাতিল করার মাধ্যমে কাজে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে ইউএনডিপিকে বারবার জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি— এমন অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নয় পরামর্শকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ জানান। উল্টো তিনি আইসিটি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আগারগাঁও আইডিবি ভবনের ১৯ তলায় ইউএনডিপির অফিসে ওই নয় অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে তাদের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দেন। এ ঘটনায় আইসিটি বিভাগ ও এটুআই একাধিকবার আপত্তি জানালেও তা আমলে নেয়নি ইউএনডিপির বর্তমান আবাসিক প্রতিনিধি।
অন্যদিকে, পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, আইসিটি বিভাগের তদন্ত কমিটি গঠনের পর থেকেই অভিযুক্তরা নানাভাবে এটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তদন্ত রিপোর্ট নিজেদের পক্ষে নেওয়ার জন্য তদন্ত কমিটিকে দেড় কোটি টাকা দেওয়ার প্রলোভনের ফাঁদও পাতেন তারা।
আরেকটি সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদন আইসিটি বিভাগ ইউএনডিপির কাছে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া আইসিটি বিভাগের বর্তমান সচিব ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধির কাছে মৌখিকভাবে ওই নয় পরামর্শকের চুক্তি বাতিলের অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালকও এ বিষয়ে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে সভা করে একই অনুরোধ জানান। কিন্তু কোনো কিছুই আমলে নেননি স্টেফান লিলার। উল্টো অভিযুক্তদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে নিয়মিত তাদের বেতন-ভাতা দেওয়ার পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালককে না জানিয়ে ছয় মাসের জন্য তাদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিংবা তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে জানতে তিন দফায় যোগাযোগ করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে। লিখিত আকারে মুঠোফোনেও পাঠানো হয় প্রশ্ন। তবে, কোনো উত্তর মেলেনি
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার নজির রয়েছে ইউএনডিপির। জানা গেছে, ২০২১ সালে এটুআইয়ের চিফ টেকনোলজি অফিসার আরফে এলাহীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তিনি একটি ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান থেকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি ও নগদ টাকা নেন। ওই অভিযোগে ইউএনডিপি তার চুক্তি বাতিল করে বহিষ্কার করে। কিন্তু এর কিছুদিন পর ইউএনডিপি আরফে এলাহীকে ব্যাংককের আঞ্চলিক সদরদপ্তরে চিফ ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন।
এ ছাড়া অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে আনীর চৌধুরী, ফরহাদ জাহিদ শেখ ও আসাদ-উজ-জামানের নামে ইউএনডিপিতে একাধিকবার দুর্নীতি, সহকর্মীর প্রতি বিরূপ আচরণ, নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানি ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করা হলেও তারা কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
যা বলছে ইউএনডিপি
বিষয়টি নিয়ে ইউএনডিপির বাংলাদেশ অফিসের হেড অব কমিউনিকেশনস মো. আব্দুল কাইয়ুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউএনডিপি এটুআই প্রকল্পের নয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে অবগত। একই সঙ্গে অভিযোগের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
তিনি বলেন, সরকারের আইসিটি বিভাগ থেকে তদন্ত কমিটির করা সম্পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদনসহ অভিযোগগুলো ইউএনডিপির অডিট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন অফিসে (ওএআই) জমা দেওয়া হয়েছে। ওএআই বর্তমানে অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করছে। তবে, প্রোটোকল অনুযায়ী তদন্তের জন্য পর্যাপ্ত ভিত্তি আছে কি না, প্রাথমিকভাবে সেটির মূল্যায়ন করা হচ্ছে। পুরো তদন্ত অত্যন্ত ন্যায্য, স্বচ্ছ, পেশাদার ও কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এ মুখপাত্র আরও বলেন, যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং এসব কর্মকর্তা ইউএনডিপির মান ও নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ইউএনডিপি যেকোনো কর্মীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। কারণ, সংস্থাটি তার নীতিমালার যেকোনো লঙ্ঘন মোকাবিলা করতে এবং আচরণের মান বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তদন্ত কমিটির কাছে কোনো জবাব দেননি ইউএনডিপির নয় পরামর্শক। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র সল্যুশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামি ১৪ অক্টোবর লিখিত জবাব জমা দিয়ে ১৫ অক্টোবর তা প্রত্যাহার করে নেন। বাকি আটজন ই-মেইলের মাধ্যমে দুই-তিনদিন সময় বাড়ানোর আবেদন জানান। পরবর্তীতে তারা সবাই ফের ই-মেইলে জানান যে, ইউএনডিপি তাদের নিয়োগকারী। অভিযোগের বিষয়ে লিখিত জবাব দেওয়ার বিষয়ে তারা ইউএনডিপি হতে কোনো সম্মতি পাননি। তাই তাদের পক্ষে কোনো লিখিত জবাব দাখিল করা সম্ভব নয়
কাজ থেকে বিরত থাকতে সরকারের দেওয়া নির্দেশনা উপেক্ষা করেই অভিযুক্ত নয় কর্মকর্তাকে ইউএনডিপি দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছে— এমন অভিযোগের বিষয়ে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ইউএনডিপি কর্মীদের বিরুদ্ধে যেকোনো শাস্তিমূলক বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নিতে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্তের নীতি অনুসরণ করে। যার মধ্যে অভিযোগের বিষয়গুলোর জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত। বিষয়গুলো নিয়ে ওএআই তদন্ত করছে। যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয় তবে তারাই এক্ষেত্রে পরিচালকদের সুপারিশ করবে। তবে, তদন্তের জন্য প্রদত্ত গোপনীয়তা সুরক্ষার কারণে কর্মীদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করা যথার্থ নয়। তবে, কোনো অভিযোগের বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকলে যে কেউ ওএআইকে সরাসরি ই-মেইলে ([email protected]) লিখতে পারেন।
মোটাদাগে সবগুলো অভিযোগের বিষয়ে ইউএনডিপির তদন্ত বিভাগ ওএআই তদন্ত করছে এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য পর্যালোচনা করছে বলে মন্তব্য করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশ অফিসের হেড অব কমিউনিকেশনস মো. আব্দুল কাইয়ুম।
মন্তব্য পাওয়া যায়নি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের
বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিংবা তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে জানতে তিন দফায় যোগাযোগ করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে। লিখিত আকারে মুঠোফোনেও পাঠানো হয় প্রশ্ন। তবে, কোনো উত্তর মেলেনি।
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক মামুনুর রশিদ ভূঁইয়ার সঙ্গেও একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।