Image description
 

রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘরখ্যাত শেখ মুজিবের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে বৃহস্পতিবার সেখানে ঢল নামে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। শুধু রাজধানী নয়, আশপাশের নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ এসেছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে।

 

চার বছরের শিশু আফিয়া থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধ, প্লে গ্রুপের ছাত্র থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা- বাদ যাননি কেউই।

 

গতকাল দিনভর ওই এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, এখানে যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। সবাই চান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানালেন তাদের অনুভূতির কথা। আবার কেউ কেউ নাম প্রকাশ করেননি কিংবা ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।

কেউ বলেছেন, ‘শয়তানের শেষ পরিণতি দেখার জন্য এখানে এসেছি।’ কেউবা বলেছেন, ‘ফেরাউনের মৃত্যুস্থান দেখতে এসেছি।’ অভিভাবকদের অনেকে বলেছেন, ছোট সন্তানকে নিয়ে এসেছেন ইতিহাসের সাক্ষী বানাতে। নিজ চোখে ফ্যাসিবাদের ধ্বংসাবশেষ দেখুক পরবর্তী প্রজন্ম। অনেকেই বলছেন, অভিশপ্ত এই ভবনকে পাবলিক টয়লেট বানানো হোক।

 

কথা হয় রাজধানীর নামকরা একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ড্রেস পরা চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে। এরমধ্যে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফ্রিদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- কেন এসেছে সে। সে বলল, ‘শয়তানের শেষ পরিণতি দেখতে এসেছি।’ তারপর পরিচয় করিয়ে দিল বন্ধু জুনায়েদ এবং আহনাফসহ আরেকজনকে। আহনাফ বলল, গণহত্যা চালিয়ে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে যেভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মেছে।

 

নরসিংদী থেকে চার শিশু বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন গৃহিণী নাসিমা আক্তার। তিনি জানালেন, গণহত্যাকারী হাসিনা ও ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা শেখ মুজিবের অপরাধের আখড়াস্থলের সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষ পরবর্তী প্রজন্মকে দেখিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি বাচ্চাদের এনেছেন।

 

আবির এসেছেন মিরপুর ১২ নম্বর থেকে। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়েন তিনি। বললেন, ‘ফেরাউনের মৃত্যুস্থান দেখতে এসেছি।’

প্লে গ্রুপের শিক্ষার্থী আহনাফকে নিয়ে এসেছেন তার মা। তিনি জানান, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানতে পারে, এই ভবনেই বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি। এখানেই যেন ফ্যাসিবাদের কবর রচনা হয়, সেটাই প্রত্যাশা।

 

মাদ্রাসাছাত্র হামিম এয়ারপোর্ট থেকে এসেছে। সে বলল, ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছি। সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। বাড়িটা শুধু ভেঙে দিয়ে বসে থাকলে হবে না, এখানে একটি পাবলিক টয়লেট বানানো দরকার। তাহলে সারাবিশ্বের স্বৈরশাসক ও গণহত্যকারীদের জন্য এটা শিক্ষা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, বুধবার রাতে আসতে পারিনি, তাই ইতিহাসের সাক্ষী হতে বৃহস্পতিবার সকাল সকাল চলে এলাম। শেখ হাসিনার পতন তার বাবার মতো অনিবার্যই ছিল, হয়তো সময় একটু বেশি লেগেছে।

 

অবসরপ্রাপ্ত এক ব্যাংকার বলেন, দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে এ দেশের মানুষকে নতুন করে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে চাইছেন। তার অনুশোচনা হচ্ছে না দেখে আমার অনুশোচনা হয়।

 

ফার্নিচার ব্যবসায়ী ইয়াসিন মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা এত বাড়াবাড়ি করেছিল যে পতন ছাড়া উপায় ছিল না। নিজে ডুবল, দেশবাসীকেও ডুবাল। তার বাবাকে ডুবাল, দলটাকেও ডুবাল।

 

৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ ইউনুস বলেন, হাসিনার ১৬ বছরের গণহত্যাসহ নির্মমতার প্রতীক এই বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে এসেছি। সাড়ে চার বছরের আফিয়া এসেছে তার মা এবং খালার সঙ্গে। শিশুটির খালা জানালেন, না এসে পারলাম না। শেখ হাসিনা অনেক কষ্ট দিয়েছে দেশের মানুষকে। যেমন বাপ তেমন মেয়ে।

 

আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাজ্জাদ হোসেন জানান, শেখ মুজিবের অবৈধভাবে দখল করা বাড়িটি পাবলিক টয়লেট বানানো দরকার। কলেজ শিক্ষার্থী শামসুন্নাহার বলেন, বাড়িটিকে পাবলিক টয়লেট বানাতে হবে।

 

সরেজমিন দেখা যায়, বৃহস্পতিবার সকালে মিরপুর রোড থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ঢুকতেই শুরু হয় মানুষের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকলে একপর্যায়ে প্রথমে ডানপাশে চারতলা একটি ভবন, যেটি শেখ মুজিবের জন্য তৈরি করা জাদুঘরের অফিস ভবন হিসেবে পরিচিত। ভবনের সামনে বিপুলসংখ্যক মানুষ। ভবনের দেয়াল ভাঙা। ভাঙাচোরা ইটের স্তূপ পেরিয়ে ভিড় ঠেলে ভেতরে গেলে দেখা যায় ভবনের সামনের অংশ ভাঙা। এক্সেভেটর দিয়ে ভবনের মূল কাঠামোর ২০-২৫ শতাংশ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ছাত্ররা। ভেতরে ঢুকে নিচতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ঘুরে ভেতরে কোথাও কোথাও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। দরজা, জানালা কিছুই নেই। ফ্লোরে পড়ে আছে ভাঙাচোরা কাচ, কাঠ এবং ইটের টুকরা।

 

এর পশ্চিম পাশে মূল ভবন। তিনতলা ভবনটি জাদুঘর হিসেবে পরিচিত ছিল। গত বুধবার রাত পৌনে ৮টা থেকে মূলত ভবনটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্যই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে। ভবনটির ওপরই কার্যত মানুষের তীব্র ক্ষোভ এবং ঘৃণা লক্ষ্য করা গেছে। ভবনের মূল কাঠামোর প্রায় ৭০ শতাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন কয়েকজন দর্শনার্থী।

 

দেখা যায়, এই ভবনের সামনে এবং ভেতরে হাজারো ছাত্র-জনতা। সামনের খালি জায়গায় ইটের স্তূপ, যেগুলো দেয়ালের ভাঙা ইটের স্তূপ বলে জানা গেল। ভবনের নিচতলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরের কোনো রুমে নেই দরজা, জানালা। কয়েকটি রুমের ভেতরে আগুন জ্বলছিল তখনো। ধোঁয়ার কারণে খুব বেশিক্ষণ থাকা যাচ্ছিল না। প্রত্যেক ফ্লোরে সবগুলো রুম দেখলে মনে হবে যেন ধ্বংসস্তূপ। কেউ কেউ সেখানে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যও করছিলেন। কাউকে কাউকে সেখানে থুথু ফেলে ঘৃণা প্রকাশ করতেও দেখা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভাসমান মানুষজন লোহার বিভিন্ন জিনিসসহ ধ্বংসাবশেষ থেকে যতটুকু পেয়েছেন নিয়ে গেছেন। তবে ছাত্রদের অনেকে ভাসমান এসব মানুষকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

 

এই ভবনের পেছনে অর্থাৎ উত্তর পাশে শেখ মুজিবের নামে মেমোরিয়াল ট্রাস্টের একটি ভবন, যেটির মূল কাঠামো অক্ষত রয়েছে। মূল কাঠামো ঠিক থাকলেও প্রতিটি ফ্লোরের দরজা, জানালাসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ভেঙে ফেলেছে উত্তেজিত জনসাধারণ। ভবনটির ভেতরে কয়েকটি রুমে আগুন জ্বলছিল। প্রতি ফ্লোরে ভাঙাচোরা কাচ এবং ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে।

 

এর আগে গত বুধবার রাত পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা এসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য জড়ো হন। একপর্যায়ে রাত ১১টার দিকে সেখানে বিল্ডিং ভাঙার যন্ত্র দিয়ে এই অভিশপ্ত বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। ১১টা ১৭ মিনিটে দেয়াল ভাঙার কাজ শেষ হলে ভেতরে প্রবেশ করে এক্সেভেটর। এ সময় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা স্লোগান এবং বিপুল করতালির মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে ওই এলাকা। ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

 

গত বুধবার সারারাত সেখানে অভিশপ্ত ভবনটি ভাঙার কাজ চলে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত দুটি যন্ত্র দিয়ে ভবন ভাঙার কাজ চলে। ওই রাতে প্রায় একই সময়ে ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের সুধাসদন খ্যাত শেখ হাসিনার বাসভবনেও হামলা চালায় হাজারো ছাত্র-জনতা। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটির লোহার মূল গেটে বড় অক্ষরে লেখা খুনি হাসিনা। চারতলা ভবনটির নিচতলায় ঢুকে দেখা গেল, ভেতরের রুমগুলো সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উপরের প্রতিটি ফ্লোরের রুমগুলোরও একই অবস্থা। উৎসুক মানুষ ধ্বংসাবশেষ এক নজর দেখতে ভিড় করছেন। এখানেও ৩২ নম্বরের মতো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা এবং বয়সের মানুষ আসছেন। তাদের অনেককে ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায়।