Image description
 

১৯৬৯ সাল। অনেকটা আকস্মিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ ডলারের ওপরের সব নোট বাতিলের ঘোষণা দেয় রিচার্ড নিক্সন প্রশাসন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছিল কালো টাকার দৌরাত্ম্য।

 

১৯৬৯ সাল। অনেকটা আকস্মিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ ডলারের ওপরের সব নোট বাতিলের ঘোষণা দেয় রিচার্ড নিক্সন প্রশাসন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছিল কালো টাকার দৌরাত্ম্য। নিক্সন প্রশাসনের এ ঘোষণায় দেশটির অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রবাহে বড় ধরনের ছেদ পড়ে যায়। একই সঙ্গে দেশটির ব্যাংক খাতের অগ্রগতিও ত্বরান্বিত হয় বলে দাবি করা হয়। এখনো বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ মূল্যমানের নোট ১০০ ডলারের।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা ও অর্থনীতিতে কালো টাকা নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ১৯৯৬ সালে সব ধরনের কাগজের নোট প্রত্যাহার করে নেয়। এর পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী পলিমার নোট চালু করে দেশটি। এ উদ্যোগের সুফলও পেয়েছিল দেশটি। অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিকে আরো বিনিয়োগবান্ধব করে তোলার ক্ষেত্রে বিষয়টির বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে এমন নোট বাতিল বা ডিমনিটাইজেশন হয়েছে দুইবার। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো দেশটিতে ৫০০ রুপি ও এর বেশি মূল্যমানের নোট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতিবাজ নেতাদের লক্ষ্য করে সে সময় এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। সে সময় জনগণকে এক সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছিল নোট পরিবর্তন করে নেয়ার জন্য। অবশ্য দেশটির মোট অর্থের বেশ ক্ষুদ্র অংশ উচ্চমূল্যের নোট হওয়ার কারণে সে সময় এ উদ্যোগের ফলে অর্থের সরবরাহ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়েনি। সব মিলিয়ে প্রথম দফায় ডিমনিটাইজেশনের মাধ্যমে কালো টাকার দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে সফল হয় ভারত। তবে দ্বিতীয় দফায় এ সাফল্যের দেখা পায়নি দেশটি। অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমানোর কথা বলে ২০১৬ সালের নভেম্বরে আকস্মিকভাবেই ৫০০ ও ১ হাজার রুপির নোট বাতিল ঘোষণা করেছিল নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকার। উচ্চমূল্যের এসব নোট বাতিলের সময় বলা হয়েছিল, ভারতে ‘‌শ্যাডো ইকোনমি বা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির দাপট কমাতে ‘‌নোট বন্দি’ করা হয়েছে। যদিও পরে আবার ২ হাজার রুপিরও নোট ছাপিয়েছিল ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাজার থেকে উচ্চমূল্যের এ নোটটিকেও প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)।

 
lead-inside

বাংলাদেশেও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশে কালো টাকা ও আর্থিক অপরাধের দৌরাত্ম্য কমাতে ১ হাজার টাকার নোট বাতিল হতে পারে বলে গুঞ্জন উঠেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এ পথে হাঁটেনি অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমানে দেশের ছাপানো নোটের ৫৩ শতাংশই ১ হাজার টাকার। সর্বোচ্চ অংকের এ নোটের সিংহভাগই এখন অর্থনীতির মূল স্রোত তথা ব্যাংক খাতে নেই। অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা হিসেবে বিপুল এ অর্থের বড় অংশ মানুষের ঘরের সিন্দুকে তালাবদ্ধ হয়ে গেছে। বাকি অংশও ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের পক্ষে সুযোগ ছিল মূল স্রোতের বাইরে চলে যাওয়া এ অর্থ অর্থনীতিতে ফেরানোর। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

 

যদিও বাংলাদেশে এখন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধের অর্থনীতি। ঘুস-চাঁদাবাজির মাত্রা আবার বেড়েছে। আওয়ামী লীগের আমলে দেশে বড় অংকের ঘুসের লেনদেন ও দেনদরবারের প্রধানতম স্থান হিসেবে অভিজাত ক্লাব ও পাঁচ তারকা হোটেলগুলো ব্যবহৃত হয়েছে বেশি। গত ৫ আগস্টের পর এসব জায়গায় সুনসান নীরবতা নেমে এসেছিল। কিন্তু এখন আবার এসব স্থানের জমজমাট অবস্থা ফিরেছে। আবার চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে ফিরে এসেছে আগের রমরমা ভাব। দেশে পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথে বড় ধরনের ব্যাঘাত তৈরি করছে চাঁদাবাজি।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে স্বর্ণ চোরাচালানের মাত্রা বেড়েছে। বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা স্থান থেকে এসে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। এর পর তা সীমান্তবর্তী জেলাগুলো দিয়ে প্রবেশ করছে বৈশ্বিক স্বর্ণের বৃহত্তম ভোক্তা দেশ ভারতে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো দিয়ে এ স্বর্ণ পাচারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ঘটনাও এখন অনেক বেড়েছে। গত ২৮, ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি লিবিয়া উপকূলে ২৩ মরদেহ ভেসে আসে। তাদের সবাই বাংলাদেশী। দালালের মাধ্যমে ইউরোপে অভিবাসন নিতে গিয়ে মানব পাচারের শিকার হয়েছিলেন তারা। গত ৩১ জানুয়ারি লিবিয়ায় ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা দুই যুবককে গুলি করে হত্যার পর পরিবারের কাছে তাদের ছবি হোয়াটসঅ্যাপ মারফত পাঠিয়েছে মানব পাচারকারীরা। ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা দাবি করা হয়। বড় অংকের অর্থ পরিশোধের পরও আরো টাকা চেয়ে না পাওয়ায় তাদের হত্যা করা হয়।

এ ধরনের নানা অপরাধের মাধ্যমে উপার্জিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগও রয়ে গেছে। এলাকাভেদে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমিতে প্রতি বর্গমিটারের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শিত করার সুযোগ রয়ে গেছে এখনো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ আমলে চালু হওয়া সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাজেটের সময় ঘোষিত আবাসন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত পরিমাণে কর পরিশোধের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ (কালো টাকা) প্রদর্শিত (সাদা) করা সংক্রান্ত বিধানটি এখনো বহাল রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের ভাষ্য হলো, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল একটি রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এ সরকারের ওপর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন ছিল। সরকার যদি ১ হাজার টাকার নোট বাতিলের মতো সাহসী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারত, তাহলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ সহজ হতো। আবার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতা, সরকারি আমলা ও অলিগার্কদের হাতে থাকা কালো টাকাও কাগজে রূপান্তর হতো। অবৈধ সে অর্থ অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার কাজে ব্যবহারের সুযোগও থাকত না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের জুন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকাই ছিল ১ হাজার টাকার নোট হিসেবে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৫২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। একই সময়ে ৫০০ টাকার নোট হিসেবে বাজারে প্রচলিত ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৩৯ দশমিক ২১ শতাংশ হলো ৫০০ টাকার নোট। তাছাড়া এ সময়ে ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা সমমূল্যের ২০০ টাকার নোট ও ১২ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা সমমূল্যের ১০০ টাকার নোট বাজারে ছিল।

সর্বশেষ গত ১৪ জানুয়ারি শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যু করা নোটের পরিমাণ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকায়। এখনো এ অর্থের বড় অংশ রয়ে গেছে ব্যাংকের বাইরে। গত নভেম্বর শেষে দেশে ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। বর্তমানেও এ অবস্থার খুব বেশি হেরফের হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পর যত দ্রুত সম্ভব ১ হাজার টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এ থেকে বেশি সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু সেটি করা হয়নি। এরই মধ্যে নোট বাতিল করা হতে পারে এমন গুঞ্জনের কারণে অবৈধ অর্থের মালিকরা সতর্ক হয়ে গেছেন। ফলে শুরুতে করা হলে বাড়তি যে সুবিধা পাওয়া যেত সে সম্ভাবনা আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। এখন ছয় মাস পর ১ হাজার টাকার নোট বাতিল করা হলে এর থেকে কী সুবিধা পাওয়া যাবে এবং এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যয় কী হবে সেটি মূল্যায়ন করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের অর্থনীতিতে যে দুরবস্থা সেটির মূল কারণ হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু অর্থনীতির ক্ষেত্রেই নয়, সব ক্ষেত্রেই সরকার সঠিক সময়কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তাদের মধ্যে অ্যাডহক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা কাজ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পিছিয়ে আসার নজিরও রয়েছে। গত আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের যে সুযোগ ছিল সেটি আমরা হারিয়েছি। সব সময়ই আমরা এভাবে সুযোগ হারাচ্ছি। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’

২০২৩ সালের জুন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যু করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৪ দশমিক ১৯ শতাংশ বা ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৮ কোটি টাকা ছিল ১ হাজার টাকার নোট এবং ৩৮ শতাংশ বা ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা ছিল ৫০০ টাকার নোট। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন শেষে ইস্যুকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩১৮ কোটি টাকাই ছিল ১ হাজার টাকার নোট হিসেবে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৫২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। একই সময়ে ৫০০ টাকার নোট হিসেবে বাজারে প্রচলিত ছিল ৯৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৩৮ দশমিক ৮০ শতাংশ হলো ৫০০ টাকার নোট। যদিও মাত্র পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত ১ হাজার টাকার নোটের মূল্যমান ছিল ৭৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। ওই সময় ৬১ হাজার ২৯২ কোটি টাকা ছিল ৫০০ টাকার নোট।

বাংলাদেশে উচ্চমূল্যের নোট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। আবার ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও কালো টাকা হিসেবে সিন্দুকে চলে যাচ্ছে। হুন্ডিসহ অবৈধ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেও ১ হাজার টাকার নোটই বেশি ব্যবহার হচ্ছে। চাহিদা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বেশি বেশি উচ্চমূল্যের নোট ইস্যু করছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ছায়া অর্থনীতি (শ্যাডো ইকোনমি) মূল অর্থনীতির চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলছেন, যেটি হয়নি, সেটি নিয়ে পড়ে না থেকে এখন সরকারের দায়িত্ব হবে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলন ও জমা দেয়ার সীমা বেঁধে দেয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি নির্দেশনা দেয়, কোনো ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ২ লাখ টাকার বেশি এক সঙ্গে জমা কিংবা উত্তোলন করতে পারবেন না। তাহলে ব্যাংকে টাকার প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি অপরাধও কমে আসবে। কারণ অবৈধ কাজ ছাড়া নগদ টাকার খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। জমি কিংবা বাড়ি-গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে পে-অর্ডার করার শর্ত আরোপ করতে হবে। তাহলে মানুষের নগদ টাকা উত্তোলনের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে।’

দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে কেন্দ্র করে অবৈধ হুন্ডির ব্যবসা এখন জমজমাট। প্রবাসীদের একটি অংশও সহজলভ্যতা ও ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা প্রাপ্তির আশায় রেমিট্যান্স প্রেরণে হুন্ডিকে বেছে নিচ্ছেন। আবার দেশ থেকে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রেও হুন্ডি কারবারিরা ভূমিকা রাখছেন। দেশব্যাপী পরিচালিত হুন্ডির অর্থ লেনদেনে প্রয়োজন হচ্ছে বিপুল অংকের নগদ টাকার। এক্ষেত্রে ১ হাজার টাকার নোটই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেশে স্বর্ণ চোরাচালানও বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রে নগদ অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও ১ হাজার টাকার নোটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে ১ হাজার টাকার নোট বাতিলের গুঞ্জন ওঠে। সে সময় বিষয়টি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। দুজনেই এ ধরনের কোনো কিছু করা হবে না বলে সে সময় জানিয়েছিলেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডিমনিটাইজেশন করতে গেলে সামষ্টিক ও ব্যস্টিক অর্থনীতিতে আঘাত আসবে। সাধারণ মানুষের ওপরও প্রভাব পড়বে। আমাদের অর্থনীতি এখনো নগদ অর্থনির্ভর। ফলে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটবে অর্থনীতি নিম্নমুখী ধারায় চলে যাবে। বর্তমান সরকার হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার এবং তারা সাময়িক সময়ের জন্য এসেছে। এ অবস্থায় এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নিলে অর্থনীতিতে এর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে সেজন্য তাদেরকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। তবে এটি ঠিক যে ডিমনিটাইজেশন করা হলে চোরাচালান ও কালো টাকার অর্থনীতি কমবে। কিন্তু এজন্য সময় লাগবে। অর্থনীতি একটু শক্তিশালী অবস্থানে এলে এটি করা যেতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করলে সবচেয়ে ভালো হবে বলে আমি মনে করি। তারা পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকবে। ফলে তাদের জন্য সময় নিয়ে এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া সহজ হবে।’

দেশে ঘুসের লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে ১ হাজার টাকার নোট। গত আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পতিত সরকারের নেতা, আমলা ও ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরে অভিযান চালানোর সময় অনেক নগদ অর্থ উদ্ধার হয়েছে। এক্ষেত্রেও ১ হাজার ও ৫০০ টাকার নোটের ব্যবহার হয়েছে। তাছাড়া রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোয় অনেকের বাসাবাড়িতে সেফ লকারে বড় অংকের অবৈধ আয় নগদ অর্থ হিসেবে রাখা আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অভিজাত এলাকাগুলোয় সেফ লকারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এসব লকারে রাখা নগদ অর্থ মূলত ১ হাজার টাকার নোটের। পাশাপাশি লকারে ডলারসহ উচ্চমূল্যের বিদেশী মুদ্রাও সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে বলে আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট কিছু সূত্রের কাছে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে। ডলার কেনার ক্ষেত্রেও হাজার টাকার নোটই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। নগদ অর্থ ঘরে রাখতে উচ্চমূল্যের নোটের সহজলভ্যতা বড় ভূমিকা রাখছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

তবে যথাযথ উদ্যোগ ও প্রস্তুতি না নিয়ে এখনই ডিমনিটাইজেশনের পথে হাঁটতে গেলে অর্থনীতিতে বিঘ্ন ঘটবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের অনেকে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে করে অর্থনীতির গতি বেশ শ্লথ হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রণা হচ্ছে অর্থনীতির এ শ্লথগতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কখনই যন্ত্রণাবিহীন হয় না। এ সময়ে ডিমনিটাইজেশন করা হলে সেটি অর্থনীতিতে আরো বিঘ্ন ঘটাবে।’

অর্থনীতির চাহিদার নিরিখে মুদ্রা ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। বাংলাদেশে সরকারি মুদ্রা হলো ১, ২ ও ৫ টাকার নোট ও কয়েন। সরকারের ইস্যুকৃত এ ধরনের মুদ্রা রয়েছে ১ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার। তবে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপে সরকারি মুদ্রা এরই মধ্যে বাজারে উপযোগিতা হারিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত ও গভর্নরের স্বাক্ষরযুক্ত নোট ‘‌ব্যাংক নোট’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক নোট হলো ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ এবং ১ হাজার টাকার কাগুজে মুদ্রা।