Image description

হলুদ জার্সি, লুঙ্গি আর জুতা পায়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন আবুল হোসেন। ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আবুল হোসেনের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জানিয়েছিলেন, আবুল হোসেনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভ্যানে তোলা হয়েছে। তার পর থেকে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গ, কারাগার, এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আবুল হোসেনকে খোঁজেননি তাঁর স্ত্রী লাকী আক্তার।

 

প্রথম আলোকে লাকী আক্তার বলেন, ‘প্রথমে ভাবছিলাম স্বামী বাঁইচ্যা আছে। তবে ঘটনার প্রায় ২৫ দিন পর আশুলিয়া থানার সামনে ভ্যানে লাশের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়। ভ্যানে লাশের স্তূপে হলুদ জার্সি পরা একজনকে দেখি। আমি তো দেইখ্যাই চিন্না ফালাইছি। সেই দিন তো এই জার্সি গায়ে দিয়াই বাইর হইছিল।’

 

আবুল হোসেনের মতো কতজনের লাশ এখনো পরিবার পায়নি, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

এরপর খোঁজ করতে করতে জানা যায়, আশুলিয়ায় এক জায়গায় দুজনকে কবর দেওয়া হয়েছিল। লাকী আক্তার কাপড় ও স্বামীর যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে একজনেরটা মিলে যায়। এর মধ্যে লাকী আক্তার থানায় স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেন।

 

অবশেষে প্রায় ছয় মাস পর ১ ফেব্রুয়ারি আশুলিয়া থানা-পুলিশ বগাবাড়ির আমবাগান এলাকার কবরস্থান থেকে দুটি লাশ তোলে। এর মধ্যে একটি মরদেহ আবুল হোসেনের (৩৩) বলে দাবি করেছেন তাঁর স্ত্রী লাকী আক্তার। লাশের পরিচয় নিশ্চিত হতে কবর থেকে তোলা দুটি লাশের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে।

 

২০১২ সালে বিয়ের পর থেকেই লাকী স্বামীর সঙ্গে আশুলিয়ায় থাকতেন। আবুল হোসেন দিনমজুর ছিলেন। ১১ বছর ও ১২ মাস বয়সী দুই সন্তান নিয়ে একবার বাবার বাড়ি, আবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকেন লাকী। ভিডিওতে সব স্পষ্ট থাকলেও স্বামীর লাশ পাওয়া না যাওয়ায় শহীদ হিসেবে গেজেটে নাম নেই আবুল হোসেনের। কোনো অনুদানও পাওয়া যায়নি। গত সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুনিবন্ধন সনদে আবুল হোসেনের মৃত্যুর কারণের জায়গায় হত্যা কথাটি লেখা আছে।

 

আবুল হোসেনের মতো এমন কতজনের লাশ এখনো পরিবার পায়নি, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। আর পরিবার মামলা না করলে বা লাশের পরিচয় শনাক্তে আবেদন না করলে আদালতের নির্দেশে লাশ তোলা বা ডিএনএ পরীক্ষা করাও সম্ভব নয়।

 

আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতে ‘গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করেছে সরকার। গত ১০ নভেম্বর এক গণবিজ্ঞপ্তিতে নিহত, নিখোঁজ, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে যাঁদের দাফন করা হয়েছে, তাঁদের পরিচয়–প্রমাণসহ স্বজনদের আবেদন করতে বলা হয়। এ সেলের সদস্য মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা বলেন, পরিবারের কাছ থেকে এ ধরনের আবেদন তেমন একটা পাওয়া যায়নি।

 

নিখোঁজ বা বেওয়ারিশ লাশের তালিকা নেই

 

আবুল হোসেনের পরিবারের মতো মো. হাসানকেও হন্যে হয়ে খুঁজছিল তাঁর পরিবার। ৫ আগস্ট মো. হাসান সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হন। এর পর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ ছিল না। হাসান ঢাকার কাপ্তানবাজারে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের একটি দোকানের কর্মী ছিলেন। থাকতেন যাত্রাবাড়ীর সুতি খালপাড় বালুর মাঠ এলাকায়। হাসানের বাবা ভোলায় কৃষিকাজ করেন। দুই ভাই–বোনের মধ্যে হাসান বড়।

 

হাসানের চাচা নূরে আলম ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে অসংখ্যবার খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু ভাতিজার কোনো হদিস পাননি। গত ১২ জানুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেলের সহায়তায় হাসানের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মর্গে থাকা একটি লাশের মিল পান নূরে আলম।

 

এর আগে ১০ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ এ সেল প্রথমে ঢাকা মেডিকেলের কলেজের মর্গে থাকা (শাহবাগ থানার অধীন) ৬ বেওয়ারিশ মরদেহের তথ্য সামনে আনে। তখনই যাত্রাবাড়ী থানার আরেকটি লাশ মর্গে আছে, এমন তথ্য পান এ সেলের সদস্যরা। আর এ লাশই হাসানের বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

নূরে আলম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ডিএনএ টেস্টের জন্য সিআইডি ল্যাব থেকে হাসানের মা–বাবার ডিএনএ নমুনা নিয়েছে ২০ দিন আগে। এখনো ফলাফল জানা যায়নি। হাসানকে খুঁজে পেতে অনেক জায়গায় ঘুষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে।

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গঠিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেলের সম্পাদক হাসান ইনাম প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে গিয়ে কতজন নিখোঁজ হয়েছেন বা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে, ছয় মাসেও তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার চাইলে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিখোঁজের তালিকাও করতে পারত।

 

মোহাম্মদ হৃদয়ের (২০) লাশও এখন পর্যন্ত খুঁজে পায়নি তাঁর পরিবার। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর শরীফ জেনারেল হাসপাতালের সামনের এক রাস্তায় হৃদয়ের কাছে এসে পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দেন এক পুলিশ সদস্য। তারপর পুলিশ হৃদয়ের দেহ একটি গলির দিকে টেনেহিঁচড়ে নিচ্ছে, এমন ভিডিও দৃশ্যও আছে। তবে এর পরের আর কোনো ফুটেজ নেই। হৃদয়ের পরিবার ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁর লাশ খুঁজছে।

 

সংসারের অভাব-অনটনের জন্য টাঙ্গাইলের হেমনগর ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতেন হৃদয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ জাস্টিস প্রজেক্ট এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট হৃদয়ের ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছে। সেই প্রামাণ্যচিত্রে হৃদয়কে গুলি করার সেই দৃশ্যও ছিল। মূলত তার পর থেকেই হৃদয়ের ঘটনা আবার আলোচনায় আসে।

 

লাশ পাওয়া যায়নি বলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মারা যাওয়া অন্য শহীদদের পরিবার বিভিন্ন অনুদান পেলেও হৃদয়ের পরিবার কোনো অনুদান পায়নি। শহীদের তালিকায়ও জায়গা পাননি হৃদয়। হৃদয়ের দুলাভাই মো. ইব্রাহিম বাদী হয়ে গত ২৬ আগস্ট কোনাবাড়ী থানায় হৃদয়কে গুলি করে হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে মামলা করেন।

 

হৃদয়ের বড় বোন মোছাম্মৎ জেসমিন টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ গুলি করে ভাইটারে মারছে, তার ভিডিও আছে। লাশ তো আর বাংলাদেশের বাইরে পাঠায় নাই। ভাইয়ের লাশ না পাইলেও শুধু ভাইয়ের হাড্ডি হইলেও ফেরত চাই।’

 

লাশ শনাক্তকরণের দাবি

 

সিটি করপোরেশন থেকে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ–সংলগ্ন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছে সংস্থাটি।

 

এ সংস্থার হিসাব বলছে, রায়েরবাজার কবরস্থানে জুলাই মাসে ৮০ এবং আগস্ট মাসে ৩৪ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। তবে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া কতজন আন্দোলনে গিয়ে বা গুলিতে মারা গেছেন, তা বলা সম্ভব নয়।

 

স্বজনেরা আঞ্জুমান মুফিদুলে বেওয়ারিশ লাশের ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়ার পর ছুটে যান রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ–সংলগ্ন কবরস্থানে। সেখানকার ৪ নম্বর ব্লকে একটু পরপর ছোট ছোট বাঁশ পুঁতে একজন করে ‘বেওয়ারিশ’ লাশের কবর চিহ্নিত করা আছে। এর বাইরে কোনটি কার কবর বা অন্য কোনো চিহ্ন নেই। এখানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে, এমন পরিবারের সদস্যরা ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ শনাক্তকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন।

 

নিখোঁজ ব্যক্তি ও অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী কমিশন বা সেল গঠনের সুপারিশ করেছেন সিআইডির (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবের প্রধান আহমাদ ফেরদৌস। তিনি বলেন, শুধু সিআইডি বা একক কোনো সংস্থার পক্ষে কাজটি করা কঠিন। প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তি ও অজ্ঞাত লাশের একটি অনলাইন ডেটাবেজ থাকতে হবে।