Image description

রাজধানীর গুলশান ২-এর ৭৫ নম্বর সড়ক, যা এক সময় পরিচ্ছন্ন ও শান্ত অভিজাত সড়ক হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন তা রূপ নিয়েছে অবৈধ ব্যবসা ও পার্কিংয়ের স্বর্গরাজ্যে। প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে চলছে দোকান, চায়ের স্টল, ভাতের হোটেল-এমনকি গ্যারেজও।

সড়কের দুই পাশে সারি সারি গাড়ি, বেশির ভাগই ইউনাইটেড হাসপাতাল, আশপাশের স্কুল এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। রাজনৈতিক নেতা, একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চলছে এখানকার ফুটপাত ও সড়ক ভাড়া দেওয়ার রমরমা বাণিজ্য। তবে কার কাছে এ টাকা যায়, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি।

গুলশান ২-এর স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ৭৫ নম্বর সড়কের পুরোটাই স্থানীয় ইউনাইটেড হাসপাতালের গাড়ির নিরাপদ পার্কিং। এছাড়া রয়েছে স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকদের গাড়ি, শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য গাড়ি, রিকশা ও বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ি। গাড়ি পার্কিংয়ের এ প্রবণতা ৮৪ নম্বর রোড ছাড়িয়ে ৭৯ নম্বর রোড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এ গাড়ি পার্কিংকে কেন্দ্র করে সড়কসহ চারপাশের ফুটপাতও হকারদের দখলে চলে গেছে। ৭৫ নম্বর সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে অন্তত ছয়টি ভাতের হোটেল, দুটি খিচুড়ির হোটেল, চায়ের দোকান, পিঠাপুলির ভ্রাম্যমাণ দোকান, ফলের দোকান, গাড়ি সারানোর গ্যারেজÑএমনকি ভাঙারি দোকানেরও দেখা মিলেছে সেখানে। এছাড়া ফুটপাতের বেশকিছু জায়গা ময়লা-আর্বজনার ডাস্টবিন ও খোলা টয়লেটে পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে পুরো ফুটপাত চলাচলের অযোগ্য হয়ে গেছে।

হাঁটার অযোগ্য ফুটপাত ও রাস্তায় সারি সারি গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে অভিজাত এ এলাকায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে যানজট। রাস্তায় রাখা গাড়িগুলোর ১৫-১৬ জন চালকের সঙ্গে কথা হয় আমার দেশের এ প্রতিবেদকের। তারা সবাই ইউনাইটেড হাসপাতালে এসেছেন, কোনো গাড়ি হাসপাতালের চিকিৎসকদের। কোনো গাড়ি আবার রোগী বা তাদের আত্মীয়স্বজনদের। কিছু গাড়ি আবার ৭৫ নম্বর রোডের স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের গাড়ি।

অধিকাংশ চালক জানান, হাসপাতালে গাড়ি পার্কিং করার জায়গা থাকে না। তাই তারা রাস্তাতেই গাড়ি রাখেন। তিন ঘণ্টা গাড়ি রাখার জন্য গুনতে হয় ৮০ টাকা করে। এরপর প্রতি ঘণ্টা ৩০ টাকা করে দিতে হয়। চালকরা বলেন, সড়কে গাড়ি রাখলে আমাদের লস হয়। কিন্তু হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না বলে আমাদের এখানে গাড়ি রাখতে হচ্ছে। তবে কাদের এ অর্থ দিতে হচ্ছে, সে ব্যাপারে তারা কোনো কথাই বলতে চাননি।

স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের গাড়ির আরেক ড্রাইভার মামুন বলেন, ‘স্কুলে বাচ্চা নিয়ে আসতে হয়। জায়গা নাই, তাই এখানেই গাড়ি রাখতে হচ্ছে।’

গত সোমবার গুলশান এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, ইউনাইটেড হাসপাতালের সামনে থেকে শুরু করে গুলশান-২ নম্বরের ৭৫ নম্বরের পাশাপাশি ৮৪, ৭৯ নম্বরসহ বিভিন্ন সড়কের ফুটপাত ভরে গেছে নানা ধরনের অবৈধ দোকানপাটে। ফুটপাত দখল করে অস্থায়ী এসব দোকান গড়ে তোলায় বাধ্য হয়ে পথচারীদের হাঁটতে হয় সড়ক ধরে।

এসব দোকানের হকাররা বলেন, তারা প্রথমে এককালীন কিছু অর্থ দিয়ে সেখানে ব্যবসা শুরু করেছে। আগে দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া দিলেও বেশ কিছু ফুটপাতকে ‘পজিশন’ হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব দোকান থেকে মাসিক ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। জায়গার গুরুত্বভেদে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকায় একেকটি পজিশন বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাতের দুর্বল দোকানদারদের তুলে দিয়ে দখলবাজরা মোটা অঙ্কের টাকায় নতুন করে পজিশন বিক্রি করছে।

জানা গেছে, ভাতের দোকান, চায়ের দোকান ও ফলের দোকানপ্রতি এককালীন পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিটি দোকান থেকে মাসিক ভাড়া হিসেবে দুই-আড়াই হাজার টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় কিছু বিএনপি নেতারা। এতে উত্তর সিটি করপোরেশন ও পুলিশের কিছু সদস্যের পকেট ভারী হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভাতের হোটেলের ব্যবসায়ী আমার দেশকে বলেন, আগে টাকা নিত যুবলীগ। এখন টাকা নেয় স্থানীয় যুবদল নেতারা। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে। এখানে বসার জন্য বহুবার এককালীন টাকা দিতে হয়েছে। এরপরও শান্তি নাই। সিটি করপোরেশন এসে দুইবার উচ্ছেদ করে গেছে।

৮৪ নম্বর রোডের চায়ের ব্যবসায়ী ফরিদা বেগম আমার দেশকে বলেন, শুনেছি এখানে গুলশান সোসাইটি ও সিটি করপোরেশন মিলে হকারদের ব্যবসার জন্য স্থায়ী কার্ড করে দেবেন। কার্ড করে দিলে আমরা ব্যবসা করতে পারব। গরিব মানুষ আমরা, তুলে দিলে আমরা খাবটা কী?

স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক নেতা, অসাধু পুলিশ সদস্য ও প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে চলছে এ মহাবাণিজ্য। প্রতিদিন শত শত গাড়ি পার্কিং আর ফুটপাতের দোকানের টাকায় ফুলেফেঁপে উঠছে তাদের পকেট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান ২-এর এক বাসিন্দা আমার দেশকে বলেন, স্থানীয় বিএনপি নেতারা সড়ক আর ফুটপাতে চাদাঁবাজি করতে এসব অবৈধ ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আমরা যখন সকালে হাঁটতে বের হই তখনো দেখা যায় পুরো ফুটপাত দোকানিদের দখলে। ফুটপাতের জায়গায় জায়গায় আবার ড্রাইভাররা প্রস্রাব করে রাখে। ফলে সেখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ারও কোনো জায়গা অবশিষ্ট থাকে না। বাধ্য হয়েই আমাদের মূল সড়কে নেমে যেতে হয়। সেখানেও গাড়ি রাখা থাকে। কোনোভাবেই চলাফেরা করা যাচ্ছে না। গাড়ি নিয়ে বের হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতে হয় যানজটে।

গুলশান সোসাইটি সড়কের বিভিন্ন স্থানে ব্যানার টাঙিয়েছে—‘ফুটপাত বা সড়কে ময়লা ফেললে জরিমানা’। কিন্তু ব্যানারের ঠিক নিচেই ময়লার স্তূপ, দুর্গন্ধ আর পাশে খোলা টয়লেট। এমন পরিস্থিতি প্রায় রাস্তা জুড়েই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ এ বিষয়ে বলেন, গুলশানের রাস্তাঘাট ও ফুটপাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব গুলশান সোসাইটিকে দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যর্থ হলে আমরা নিজেরাই উচ্ছেদ অভিযানে নামব। তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেন, ফুটপাতে ব্যবসার জন্য বা সড়কে পার্কিংয়ের কোনো কার্ড সিটি করপোরেশন দেয়নি। এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গুলশান সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রানা হাবিবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

গুলশান থানার ওসি হাফিজুর রহমান এ বিষয়ে আমার দেশকে বলেন, অবৈধ ফুটপাত দখল এবং জনদুর্ভোগের বিষয়ে পুলিশ নিয়মিতভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে। বৃহস্পতিবারও ৫১ নম্বর রোডে অভিযান চালানো হয়েছে। ৭৫ নম্বর রোডেও অভিযান চলবে। ফুটপাত দখল করে দোকান বসানো এবং অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে রাখার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই।