
আবাসিক এলাকাটির বিভিন্ন প্লটে একে একে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। মাঝে একটি প্লট চারপাশে দেওয়াল-টিন দিয়ে ঘেরা। ভেতরে আড়াআড়িভাবে রাখা একটি উড়োজাহাজ। চলার পথে এমন দৃশ্য দেখে থমকে যান অনেক পথচারী। ভাবেন, এত বড় উড়োজাহাজ প্রাচীরের মধ্যে ঢুকলো কীভাবে!
কার্যত এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সেখানে নেই কোনো তত্ত্বাবধায়ক। মাঝে মধ্যে কিছু মানুষ আসেন। তারা কেন আসেন তা ঠিক জানেন না এলাকাবাসী। তবে দু-একজন এখানে আসা ব্যক্তিরা কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বলে জানান।
আবাসিক প্লটে উড়োজাহাজ ফেলে রাখার এ চিত্র রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির। সেখানে ১৫ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ১৩ নম্বর প্লটে এ উড়োজাহাজটি রাখা হয়েছে।
সাধারণত বিমানের বহরে থাকা কোনো উড়োজাহাজ পুরোনো বা নষ্ট হয়ে গেলে নিলামে বিক্রি করা হয়। এমন কয়েকটি উড়োজাহাজ ২০১৯ সালের আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছে বিমান। এসব প্রতিষ্ঠান গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজে তা ব্যবহার করে। আবার অনেকে তা কেটে ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করে।- বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এ বি এম রওশন কবির
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দীর্ঘ ৯ বছর ধরে উড়োজাহাজটি দিয়াবাড়িতে পড়ে রয়েছে। কেউ কেউ ছয় বছর বলেও দাবি করেন। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। এর মধ্যে যারা হঠাৎ উড়োজাহজটি দেখেন, তখন তাদের জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু প্লটের সামনে এই উড়োজাহাজ কী উদ্দেশ্যে, কারা রেখেছেন তার তথ্য সম্বলিত কোনো বোর্ড নেই। এ কারণে উড়োজাহাজটি ঘিরে এক ধরনের রহস্যের জন্ম হয়েছে।
স্থানীয়দের কয়েকজন জানান, ওই প্লট ভাড়া নিয়ে উড়োজাহাজটি রেখেছে উত্তরার একটি প্রকৌশল কলেজ। বছরের বিভিন্ন সময় ব্যবহারিক ক্লাস করতে সেখানে যান কলেজটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
গত ২১ জুলাই উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের হায়দার আলী ভবনে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ক্যাম্পাসের সামনে তথা মেট্রোরেল ভবনের দক্ষিণ পাশের একটি প্লটে উড়োজাহাজটির অবস্থান।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ১৫ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ১৩ নম্বর প্লটের উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণ পাশ প্রায় সাত ফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। আর সামনের অংশে টিনের বেড়া দেওয়া। মধ্যে ছোট একটা দরজা বা পকেট গেট রয়েছে। কিন্তু গেটে তালা লাগানো। ফটকের সামনে প্লট মালিকের কোনো নাম-ঠিকানা নেই।
তবে বাইরে থেকে উড়োজাহাজটি দেখা যায়। এটির গায়ের রং সাদা। ওপরে জানালা-দরজা বরাবর লাল-সবুজের রং করা। এটি কোন এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজ তার নাম বা চিহ্ন-লোগো নেই। প্রায় ছয় কাঠা আয়তনের প্লটের ভেতর আড়াআড়ি করে রাখা হয়েছে। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় উড়োজাহাজের দুপাশের ডানা ভেঙে কাত করে রাখা। ইঞ্জিনসহ পেছনের অংশ ঢেকে আছে লতাপাতায়। জানালায় কয়েক স্তরে ধুলাবালির স্তূপ। চাকায় হাওয়া না থাকায় টায়ার মাটিতে বসে গেছে।
পাশের ১২ নম্বর প্লটে বহুতল ভবনের পাইলিংয়ের কাজ চলছে। এখানে প্লট মালিকের পক্ষে কাজ করেন আলী আশরাফ। তিনি বলেন, ‘ছয় বছর আগে বড় লরি ও ক্রেনের সাহায্যে এই প্লটে উড়োজাহাজটি রাখা হয়েছে। কিন্তু কারা রেখেছে তা জানি না। মাঝে মধ্যে দেখি কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা এখানে আসেন। উড়োজাহাজটি ঘুরে দেখেন। আবার তারা চলে যান। তবে মহল্লার মানুষের এ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। কেন, কীভাবে এ উড়োজাহাজটি এখানে রাখা হয়েছে, তারা তা জানতে চান।’
৪ নম্বর রোডের একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বাস করেন উত্তরার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ফরহাদ আহমেদ। প্রতিদিন বিকেলে ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে আশপাশের সড়কে হাঁটেন তিনি।
আলাপকালে ফরহাদ আহমেদ বলেন, ‘এ সড়কে হাঁটতে গেলে স্কুলপড়ুয়া ছেলে প্রায়ই উড়োজাহাজটির বিষয়ে জানতে চায়। কিন্তু ছেলেকে কিছু উত্তর দিতে পারি না। আবার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের সীমানা থেকে ওই এলাকার দূরত্বও প্রায় আট কিলোমিটার। এত দূরে উড়োজাহাজটি কীভাবে এলো তার রহস্যও আমরা খুঁজে পাই না।’
উড়োজাহাজটির তথ্য জানতে সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান কার্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগে গেলে এটি কোন এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ রং দেখে অনেকেই বলতে পারেননি। তবে বিমানের পুরোনো এক কর্মী জানান, এটি বিমানের এফ-২৭ ডাচ কোম্পানি ফকারের নির্মিত একটি স্বল্প-পাল্লার টার্বোপ্রপ যাত্রীবাহী প্লেন। এটি সাধারণত ৪৮ থেকে ৫৬ জন যাত্রী বহন করতে পারতো। একসময় বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্স এটি ব্যবহার করেছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এ বি এম রওশন কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণত বিমানের বহরে থাকা কোনো উড়োজাহাজ পুরোনো বা নষ্ট হয়ে গেলে নিলামে বিক্রি করা হয়। এমন কয়েকটি উড়োজাহাজ ২০১৯ সালের আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছে বিমান। এসব প্রতিষ্ঠান গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজে তা ব্যবহার করে। আবার অনেকে তা কেটে ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করে। হয়তো দিয়াবাড়িতে এমনই কোনো প্রতিষ্ঠান উড়োজাহাজটি রেখেছে।’
এই উড়োজাহাজটির মালিকের খোঁজ নিতে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে আবারও দিয়াবাড়ি গিয়ে দেখা হয় ওই এলাকার চায়ের দোকানি আবুল কালামের সঙ্গে। আবুল কালাম ওই এলাকায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করেন।
আবুল কালাম বলেন, ‘উড়োজাহাজটি ৯ বছর আগে আনা হয়েছে। আগে অন্য আরেকটি প্লটে ভাড়া রাখা হয়েছিল। এখন যেখানে আছে, এটিও ভাড়া জায়গায়। এটির রক্ষণাবেক্ষণ বা দেখভাল করে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের ২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের অ্যারোনটিক্যাল ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ।’
পরে অ্যারোনটিক্যাল ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের অধ্যক্ষ এস এম আকমল হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। মেসেজেরও সাড়া দেননি। তবে তার প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, উড়োজাহাজটি তাদেরই। এটি শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাসে কাজে লাগে। কিন্তু ফটকের সামনে উড়োজাহাজটি সম্পর্ককে কোনো তথ্য সম্বলিত বোর্ড নেই কেন, এমন প্রশ্নের তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।