Image description

রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় রাতে বাস-ট্রাক এমনকি ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়েও টাকা আদায় করতে দেখা যায় কিছু মানুষকে। হাতে লাঠি, মুখে বাঁশিসহ গায়ে সিটি করপোরেশনের ভেস্ট বা জ্যাকেট পরা সংঘবদ্ধ একটি দল বিভিন্ন যানবাহনের কাছে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। মহানগরীর মতিঝিল, গুলিস্তান, সদরঘাট, সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ীসহ নগরীর অন্তত ৫০টি স্পটে এমন টাকা তোলার দৃশ্য চোখে পড়ে হরহামেশাই। তবে এই টাকা তোলাকে বৈধতা দিয়ে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কারণ পার্কিং এবং সিটি টোলের নামে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রকে ইজারা দেওয়া হয়েছে রাজধানীর রাস্তার ধার কিংবা ফুটপাত। তারা ঘণ্টা হিসাব করে চাঁদা আদায় করে বিভিন্ন যানবাহন থেকে। ইজারা বাণিজ্য থেকে ডিএসসিসির বছরে মাত্র ১০ কোটি টাকা আয় হলেও প্রভাবশালী চক্র সেখান থেকে বাণিজ্য করছে অন্তত হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন তার অনুগত রাজনৈতিক কর্মীদের আর্থিক সুবিধা দিতে ওই ‘ইজারা’ নিয়ম চালু করেন। পরবর্তী সময়ে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এর ব্যাপ্তি বাড়ান। হাতেগোনা সামান্য টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন শপিংমল, কাঁচাবাজার এবং ব্রিজ সংলগ্ন খোলা জায়গার ইজারা দেওয়া শুরু করেন। আর এসব ইজারা পান তাপসের ঘনিষ্ঠ লোকজন। আর সেই মওকায় পুরো রাজধানীর শপিংমল, হাট-ঘাট এমনকি প্রধান সড়কগুলোয় টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজির উৎসবে মেতে ওঠেন নেতাকর্মীরা। পার্কিং ফির নামে একটি চক্রকে দেদার চাঁদা তোলার পথ খুলে দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ও ফজলে নূর তাপস। তাদের বৈধতা দেওয়া চাঁদাবাজি এখনো চলছে। জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিএসসিসির সাবেক মেয়র খোকন ও তাপস পালিয়ে গেলেও রাজধানীজুড়ে পার্কিং ফি আদায়ের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের উদ্যোগ নেয়নি সিটি করপোরেশন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এখন শুধু স্থানীয় গডফাদারদের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু চাঁদা আদায়কারীরা আগের লোকজনই রয়ে গেছে। তারা রাস্তার পাশে গাড়ি থামানো মাত্রই ইজারার টাকা নেয়। আর বেশি সময় গাড়ি রাখলে টাকা নেয় ঘণ্টা হিসাব করে। এই নিয়ে হরহামেশাই গাড়িচালকদের সঙ্গে ইজারাদারদের নিয়োজিত কর্মী বাহিনীর বাগবিতণ্ডা এমনকি হাতাহাতিও হয়। ইজারার অনুমোদন থাকায় পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।

মঙ্গলবার রাজধানীর জিগাতলা ইবনে সিনার সামনে পার্কিং থেকে এক যুবকের চাঁদা তোলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। পরে মঙ্গলবার রাতেই ওই যুবককে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। তবে ওই যুবক যে স্থানে গাড়ি থামিয়ে টাকা নিচ্ছিল, সেই জায়গাটিও পার্কিং ইজারার আওতাভুক্ত বলে জানা গেছে।

 

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ৫ কোটি ৭৯ লাখ ৫২ হাজার টাকায় সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে টার্মিনাল ফি, টয়লেট, চারটি গোসলখানা ব্যবহার ও গাড়ি ধোয়া এবং কুলি মজুরি আদায়ের ইজারাদার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে ‘হিমাচল গোল্ডলাইন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই ইজারার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্থান এবং কোন কোন গাড়ি থেকে টাকা তোলা যাবে, সেটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে করপোরেশন। বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। চিটাগাং রোড থেকে শুরু করে শনির আখড়া, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, তাঁতীবাজার এলাকা থেকেও ওই প্রতিষ্ঠানের লোকজন চাঁদা তোলে। এই অঞ্চলে যাতায়াতকারী প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাক, মিনিবাসসহ বিভিন্ন পরিবহন থেকে দিন-রাত টাকা তুলছে ঠিকাদার নিয়োজিত কর্মী বাহিনী। একই অবস্থা ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল এলাকার ক্ষেত্রেও। শর্ত নির্দিষ্ট থাকলেও পুরো গুলিস্তান, বঙ্গবাজারসহ আশপাশের এলাকায় টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজি করছে ঠিকাদার নিয়োজিত কর্মীরা। এসব এলাকার মার্কেটের সামনে থেকেও আদায় করা হচ্ছে টাকা। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা মালপত্র নিয়ে মার্কেটের সামনে রাখলেই ইজারাদারের লোকজন টাকা নিচ্ছে। এতে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন সময় এসব বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন তারা।

 
 

ডিএসসিসির ব্যবস্থাপক (পরিবহন) গোলাম মোর্শেদ জানান, হিমাচল গোল্ডলাইন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আগামী ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ইজারা রয়েছে।

 

নথিপত্র বলছে, ধানমন্ডি এক নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসা বেল টাওয়ারের সম্মুখে উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী রাস্তার ওয়াসা অফিস পর্যন্ত ফুটপাত সংলগ্ন খালি জায়গায় সড়কের ওপর ২২টি কার পার্কিংয়ের সরকারি ইজারা মূল্য ৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। অথচ আশপাশের এলাকাজুড়ে দেদার টোল আদায় করা হচ্ছে।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তার উভয় পাশে খালি জায়গায় সড়কের ওপর ৮৩টি কার পার্কিং ২৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ইজারা মূল্য ধরা হয়েছে। লালবাগ শহীদ নগর বেড়িবাঁধের অধিগ্রহণকৃত লবণঘাটের বিপরীতে ৬০টি ট্রাক পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি সংলগ্ন (কফি হাউস গলি) স্টাফ কোয়ার্টারে দেয়ালের একপাশে ৭৪/১ নম্বর হোল্ডিং থেকে ৮৮/১ নম্বর হোল্ডিংয়ের সামনের জায়গায় সড়কের ওপর ১৮টি প্রাইভেটকার ও ৪৮টি মোটরসাইকেলের পার্কিং ইজারা মূল্য ৬ লাখ ১১ হাজার টাকা। বাংলামটরে সোনারতরী টাওয়ারের সম্মুখে সড়কের ওপর ১১টি কার পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের উদয়ন মার্কেটের বেজমেন্টে ২৯টি গাড়ি পার্কিংয়ে ইজারামূল্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এ এইচ এন টাওয়ারের সম্মুখে সড়কের ওপর ১০টি কার পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ২ লাখ ৩১ হাজার টাকা। পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে রাস্তার পূর্ব পাশে ও দক্ষিণ পাশে এক সারিতে ৩৫টি পার্কিংয়ে ইজারা মূল্য ৫ লাখ ৫১ হা্জার।

সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ের ফ্লাইওভারের নিচে ত্রিভুজ আকৃতির খালি জায়গায় কার পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ২৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২, ব্লক-সি এ নির্মিত বেজমেন্টে ৬৬টি কার এবং ২০টি মোটরসাইকেল পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ১৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।

নিউ এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল থেকে গাউছিয়া মার্কেট সংলগ্ন নূর ম্যানশন ২ নম্বর গেট পর্যন্ত রাস্তার একপাশে ৪৮টি কার পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এ ছাড়া নিউমার্কেটের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন ফাঁকা রাস্তায় মাত্র ১০ লাখ টাকায় ইজারা নেওয়া হয়েছে। পলওয়েল মার্কেট রাস্তার এক পাশে ১৮টি কার পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে আলমগঞ্জ মিল ব্যারাক সংলগ্ন ভূমিতে ১৮টি ট্রাক ও মিনি ট্রাক পার্কিংয়ের ইজারা ১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। রাজারবাগ দরবার শরিফের সামনে মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে ৩টি ব্লকে ২০টি কার পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

যাত্রাবাড়ী টিঅ্যান্ডডির সামনে থেকে ক্যাবেক্স সিএনজি পাম্প রাস্তার বাঁ পাশে (উত্তর পার্শ্বে) এক সারিতে ১৮০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ৫৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা। স্বর্ণ মার্কেট লিংক রোডের এক পাশে ৪৮টি গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ২২ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের বেজমেন্টে ২৪৭টি গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ২২ লাখ ১১ হাজার টাকা। অ্যাড. কামরুল ইসলাম সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্রে বেজমেন্টে ১৬ গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ৭২ হাজার টাকা। ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাকুরা মার্কেটের পেছনে খালি জায়গায় ২৮টি মোটরসাইকেল, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার পার্কিংয়ের ইজারা মূল্য ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ২৮ হাজার বর্গফুট খোলা জায়গায় গাড়ি পার্কিং করতে এক বছরের জন্য ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়।

তবে সরেজমিন তথ্য এবং সাধারণ মানুষের ভাষ্য, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যেসব এলাকার কথা উল্লেখ করে ইজারা দেওয়া হয়, সেই শর্ত মানেন না ইজারাদাররা। আশপাশের সব এলাকাতেই পার্কিং করা হয় গাড়ি। এমনকি শর্ত অনুযায়ী যে টাকা আদায় হওয়ার কথা, তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি টাকা আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো পার্কিং স্থানে গাড়ি পার্কিং না করে বসানো হয়েছে দোকান। গাড়ি পার্কিং করা হয় প্রধান সড়ক দখল করে। আর সেখান থেকেই আদায় হয় পার্কিং টোল।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী কালবেলাকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে আমার অনস্ট্রিট কার পার্কিং এলাকাগুলো নির্দিষ্ট করা রয়েছে, যা বার্ষিক হারে ইজারা দেওয়া হয়। এর বাইরে অননুমোদিতভাবে কেউ পার্কিং স্ট্রিট করলে ট্র্যাফিক পুলিশ কর্তৃক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সড়কে যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখা, যান চলাচল সচল রাখতে ডিএমপির ট্র্যাফিক বিভাগ কাজ করে। সিটি করপোরেশন থেকে যে স্থানগুলোয় ইজারা দেওয়া হয়, সেখানে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।’

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা ফারজানা খানম কালবেলাকে বলেন, ‘গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য গুলশান, বনানীসহ কিছু এলাকায় ইজারা দেওয়া থাকতে পারে। একটি গণশুনানি থাকায় এ মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না। নির্দিষ্ট জায়গা ব্যবহারের জন্য ফি নেওয়া হয়ে থাকে।’

রাস্তার ধারে ইজারার নামে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, কলাবাগান, ধানমন্ডিসহ কয়েকটি থানার ওসি বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে ইজারার নামে অর্থ আদায়ের অনুমতি থাকায় আমরা কিছু করতে পারি না। অনেক এলাকায় এলোপাতাড়ি কয়েক স্তরে গাড়ি রাখার কারণে রাস্তায় যানজট দেখা দেয়। তখনো আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে কেউ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে পুলিশ সেটা নিয়ন্ত্রণ করে।