
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে যাত্রা শুরু করেছে দেশের প্রথম ‘স্কিন ব্যাংক’, যেখানে দাতাদের ত্বক সংগ্রহ করে দগ্ধ রোগীদের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।
গত ৯ জানুয়ারি উদ্বোধন হওয়া এই স্কিন ব্যাংকে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল।
স্কিন ব্যাংকে বর্তমানে আটজন চিকিৎসক ও নার্স কর্মরত আছেন। তারা সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
চালুর পর সোমবার পর্যন্ত এই স্কিন ব্যাংকের জন্য সাড়ে চার হাজার বর্গ সেন্টিমিটার ত্বক সংগ্রহ করা হয়েছে। সাতজন দাতার শরীর থেকে নেওয়া হয়েছে এই ত্বক। আর আগুনে পোড়া তিনজন রোগীর শরীরে ব্যাংক থেকে ত্বক প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
ত্বক প্রতিস্থাপন করা রোগীরা ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির চিকিৎসকরা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাপত্র প্রকাশকারী ওয়েবসাইট ‘সায়েন্সডিরেক্ট’ বলছে, বিশ্বে প্রথম ‘স্কিন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা হয় যুক্তরাষ্ট্রে; ১৯৩৯ সালে। মার্কিন নৌবাহিনী এটি প্রতিষ্ঠা করে।
ইউরোপের প্রথম স্কিন ব্যাংক হয় চেক প্রজাতন্ত্রের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল ইন হারাডেক ক্রেলভে; ১৯৫২ সালে। ভারতে হয় প্রায় ২০ বছর আগে।

ব্যাংকে কাদের ত্বক, সংরক্ষণ কীভাবে
স্কিন ব্যাংকের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দাতার কাছ থেকে ত্বক সংগ্রহ করেন প্লাস্টিক সার্জনরা। সেটি বিশেষ পাত্রে করে নিয়ে আসা হয় স্কিন ব্যাংকে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে বায়োসেফটি কেবিনেটে রেখে ত্বকের রক্ত ও চর্বি পরিষ্কার করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রিইনজিং’।
পরিষ্কার করার পর ত্বক একটি অ্যান্টিবায়োটিক সল্যুশনের মধ্যে ডুবিয়ে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফ্রিজে রাখা হয়। এ অবস্থায় রাখা হয় তিন থেকে চারদিন। এই সময়ের মধ্যে ওই ত্বকের ‘কালচার’ করা হয়, দেখা হয় তাতে কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্য কিছু আছে কি না।
কোনো ক্ষতিকারক উপাদান না থাকলে তা তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফ্রিজারে রাখা হয়। রাখা যায় পাঁচ বছর পর্যন্ত।
কোনো রোগীর শরীরে ত্বক প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে ওই ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়। সে সময়ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত বিশেষ একটি পাত্রে ত্বক বহন করা হয়।
স্কিন ব্যাংকের সমন্বয়ক এবং বার্ন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কিন ব্যাংকের জন্য এখনও মরণোত্তর ত্বক নেওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন অস্ত্রোপচার করার জন্য কেটে ফেলা ত্বক এখন ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সাতজন দাতার ত্বক নেওয়া হয়েছে।
“অনেকেই স্থূলতার অস্ত্রোপচার করেন, এতে নাভির নিচের অংশের মাংস ফেলে দিতে হয়। চিকিৎসার ভাষায় একে বলে ‘অ্যাবডোমিনোপ্লাস্টি’। এই অস্ত্রোপচার করার পর প্রত্যেক রোগীর শরীর থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গ সেন্টিমিটার ত্বক ফেলে দিতে হয়।”
তিনি বলেন, “এই ত্বক কোনো কাজে লাগে না। আমাদের প্লাস্টিক সার্জনরা অস্ত্রোপচারের সময় ওই বাড়তি ত্বকটুকু রেখে দেন। সেটা আমরা সংগ্রহ করে ব্যাংকে রাখি।
মাহবুব হাসান বলেন, ভবিষ্যতে যারা মরণোত্তর দেহ দান করবেন, সেই দেহ থেকে ত্বক নেওয়ার চিন্তা করছেন তারা। এটা করা হলে ব্যাংকে একসঙ্গে বেশি পরিমাণ ত্বক জমা করা যাবে।
এখানে ত্বক দান করেছেন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক আমাতুল্লাহ উম্মুল ওয়ারা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সন্তান জন্মদানের সময় দুবার তার অস্ত্রোপচার হয়। হার্নিয়ার অস্ত্রোপচারও হয়। এ কারণে পেট অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি ‘অ্যাবডোমেনোপ্লাস্টি’ করান।
“এটা সৌন্দর্যের জন্য নয়, স্বাস্থ্যগত দিক থেকেই ওই সার্জারি করাতে হয়েছে। তা করতে গিয়ে আমার শরীরের অনেক চামড়া ফেলে দিতে হয়। চিকিৎসক জানতে চেয়েছিলেন বাড়তি ওই চামড়া ফেলে দেবে না স্কিন ব্যাংকে দেবে। আমি নির্দ্বিধায় বললাম ডোনেট করব।”

আগুনে পুড়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির ১০০১ নম্বর ওয়ার্ডে মাস দুয়েক ধরে ভর্তি আছে সাভারের বাড়ুইপাড়া এলাকার আট বছরের শিশু মরিয়ম। তার শরীরে স্কিন ব্যাংকের চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
মরিয়মের মা মোজেমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শীতের সময় ঠান্ডা হাত গরম করতে গ্যাসের চুলার কাছে গেলে কাপড়ে আগুন লেগে যায় মরিয়মের।
ওই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স মনিরা সুলতানা বলেন, “একজন ডোনারের চামড়া স্কিন ব্যাংক থেকে স্যারেরা তার শরীরে লাগিয়েছেন। তার শরীরে চামড়া লেগে গেছে। ওর কন্ডিশন এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।”
স্কিন ব্যাংক যে উপকার করবে
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির চিকিৎসকরা বলছেন, আট বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বার্ন ইনস্টিটিউট বিশ্বমানের। কিন্তু স্কিন ব্যাংক না থাকায় ত্বক প্রতিস্থাপন করা যেত না।
এই ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শরীরের ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেলে তাকে ‘মেজর বার্ন’ বলা হয়। এ ধরনের রোগীর শারীরিক অবস্থা ভালো হলে ত্বক প্রতিস্থাপন করা যায়। “যদি আমরা স্কিন দিতে পারি তাহলে ওই রোগীর বেঁচে থাকার সুযোগ বাড়ে। এভাবে মৃত্যুর সংখ্যা কিছু কমবে।”
তিনি বলেন, কারো শরীর পুড়ে গেলে রক্তনালিগুলো উন্মুক্ত হয়ে যায়। অ্যালবুমিন, ইলেকট্রোলাইটসহ সব ধরনের ফ্লুইড বের হয়ে যায়। এতে রোগী সেপটিসেমিয়া, এলডিএসের দিকে চলে যায়। তার মৃত্যুও হতে পারে ।
“এটাকে যদি আমরা স্কিন দিয়ে কাভার করে দিতে পারি তাহলে রোগীর ফ্লুইড লস কম হয়, শারীরিক জটিলতাগুলো কমে যায়।”
শাওন বিন রহমান বলেন, কারো শরীরের ৫০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে ত্বক প্রতিস্থাপন করাটা কঠিন। ৫০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে ওই রোগী অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার মত অবস্থায় থাকে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে চিকিৎসা নিতে আসেন ১২ হাজার ৮১১ জন। তাদের মধ্যে ভর্তি নেওয়া হয় ৪৬৮০ জনকে; মারা যায় এক হাজার দুজন।